ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

কির্সতংয়ের কান্না....

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৭
কির্সতংয়ের কান্না.... এভাবেই কাটা হচ্ছে কির্সতংয়ের বনভূমি/ছবি: বাংলানিউজ

ধনেশ পাখির পাহাড়ে গিয়েছিলাম। রুংরাং মানে ধনেশ পাখি। রুংরাং দূরের কথা একটি পাখিও চোখে পড়লো না। সব নাকি শিকার করে শেষ। বিশাল ডানা মেলে রুংরাংরা পালিয়েছে। অবশ্য আগের দিন নিচের পাহাড়ি পাড়াটায় তাদের কয়েকটি ঠোঁট দেখেছিলাম।

পাহাড়িরাই শুধু খায় না এদের, চোরা শিকারিরা কম দায়ী নয়। বসন্তের রোদঝরা সকালে ঝিরি ঝিরি বাতাস গায়ে মেখে উৎরাই পথে নামার সময় চোখ গেলো ঘন সবুজে আচ্ছাদিত বনটির ক্যানোপি লাইনটির দিকে।

কিছুক্ষণ চোখ রাখতেই হলো। আলি কদম উপজেলার এ অংশটি পুরোটাই পার্বত্যময় হলেও সে অর্থে বন অনেক আগেই উজাড় হয়ে গেছে। বিশাল মরুভূমির বুকে একখণ্ড সবুজ হয়ে টিকে আছে সে। আমরা কিন্তু আজ সেদিকেই যাবো। কির্সতং তার নাম।

বেলে পাথুরে  এক আকাশচুম্বী শিলাময় শরীর কেন্দ্র করে প্রাগৈতিহাসিক বৃক্ষরাজি মাথা উঁচু করে আছে বনটিতে। ছোট্ট এক ধরনের পাখি, ম্রো আদিবাসীদের দেওয়া আদুরে নাম কির্স। তাদের হাজারো বাসা পাহাড়টির কাঁড়া ঢালে। সে নামেই একখণ্ড পাহাড়ি বনভূমিটির নাম কির্সতং।

কাটা পড়ছে এসব বড় বড় গাছ/ছবি: বাংলানিউজআমরা তার ঠিক উল্টো পাশের রিজ লাইন ধরে আড়াআড়ি উঠে আসছি একেবারে শীর্ষবিন্দুর দিকে। অ্যাডভেঞ্চারাস মন বলছে তাড়াতাড়ি উঠে যাও। স্পিড ট্রেকিংয়ের ব্যাপার-স্যাপার আছে না!! কিন্তু বনটির আত্মা কানে কানে বলছে একটু রয়ে সয়ে যাও। অসূর্যস্পর্শা বনদেবী তাকে নিংড়ে দিতে প্রস্তুত। আশ্চর্য এক বুনোপথ। চারপাশে শত বছরের মাদার গর্জন, চাপালিশসহ হরেক রকমের গগনচুম্বী বৃক্ষের ভিড়। রুংরাংয়ের রুক্ষতা এখানে নেই। চারপাশে মুখরিত পাখির কলকুঞ্জনে। মন বলছে একটু এগোলে রাজ ধনেশের দেখাও পেতে পারি।

বনের গাছ কেটে রাখা/ছবি: বাংলানিউজপথপ্রদর্শক প্রকৃতির সন্তান সেই মুরং লোকটি জানালো শুধু কি ধনেশ, এই বনে মায়া হরিণ, বুনো শূকর কত কি তারা দেখেন। শিকার করে খান। কয়েক স্তরে বিভক্ত এর বৃক্ষ-উদ্ভিদ-গুল্ম লতা। আক্ষরিক অর্থেই এটি যথার্থ বনভূমি। নিচে পড়ে থাকা রাশি রাশি পাতায় ডুবে যাচ্ছে গোঁড়ালি। একটু কান পাতলে সাধারণ জ্ঞান থেকেই বোঝা যায় এখানে পাখির প্রজাতি অগণিত। হঠাৎ বেখাপ্পা ঠক ঠক শব্দে মৌনতা ভঙ্গ হলো। কিছু বাঙালি নওজোয়ান বিশালদেহী করাত, কুঠার আর দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

সামনেই সদ্য কাটা মাদার গর্জন গাছ। অন্তত পাঁচজন মানুষের সাধ্য নেই এর বেড় পায়। অথচ কি অনায়াসেই সে ধরাশায়ী। এবার কিন্তু চারপাশে প্রায় ফাঁকা, কোনোগাছ নেই। তার বদলে কাটা গুঁড়ির সমাহার। কাঠুরিয়াদের জিজ্ঞেস করে জানা গেলো তারা চকরিয়া থেকে এসেছেন গাছ কাটতে। নিতান্তই শ্রমিক। বেশি তথ্য পাওয়া গেলো না। তবে এটুকু বোঝা গেলো মাত্র কয়েক লাখ টাকায় অন্তত একশ থেকে দেড়শো কোটি টাকার সম্পদ লোপাট হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির যে ক্ষতি হচ্ছে তা কি টাকায় মাপা যায়?

টাটকা কাটা একটি বড় গাছ/ছবি: বাংলানিউজদেখা গেলো সাইজ করা অগণিত কাঠের লগ। এগুলোর আকার এত বড় যে এর একটি দিয়েই পুরো ঘরের আসবাবপত্র বানানো যায়। গাছটির আকার না জানি কত বড় ছিলো। আমরা আরও এগিয়ে গেলাম। মনটা ভেঙে গেছে। এতক্ষণের স্বপ্নের আবেশে কে যেনো জ্বালাময় গুঁড়ো মরিচ ছিটিয়ে দিলো। আমরা জানার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা কি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির স্বত্ত্ব নিয়ে মৌলিক সমস্যার সঙ্গে মিশে আছে কির্সতংয়ের ভাগ্যও। সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে পড়ে না অংশটুকু। ফলে মৌজা প্রধানের সম্মতিতে যে কোনো স্থাপনা এখানে করা সম্ভব।

সেটির সুযোগই নিচ্ছে বনখেকোরা। যোগাযোগের দুর্গমতার কারলে এতদিন নিরাপদ থাকলেও এখন মাত্র কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গাছ। স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সরলতার সুযোগ নিয়ে যে ক্ষতি করা হচ্ছে তা অপূরণীয়। কাছে পিঠে এমন গভীর আর কোনো বন না থাকায় এটিই ছিলো এ এলাকার জীববৈচিত্র্যের শেষ আশ্রয়স্থল। কাঠ পরিবহনের জন্য রীতিমতো থানচির তিন্দু পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। আস্তানা গেঁড়েছে বহিরাগত শতাধিক লোক।

আমরা এগিয়ে যাই আরও সামনে। এক সময় সময় ছুঁয়ে ফেললাম শীর্ষ বিন্দু। আশপাশে ন্যাড়া পাহাড়গুলো জানান দিলো কি হারাতে যাচ্ছি আমরা। বলা হয়ে থাকে একটি গাছ শুধুমাত্র একটি স্বতন্ত্র প্রাণ নয়, লক্ষ কোটি প্রাণের বাঁচার অবলম্বন। আর কির্সয়ের বিশাল এসব গাছ আসলে কত লক্ষ কোটি প্রাণের বাঁচার অবলম্বন তা জানতেও বিশাল গবেষণা প্রয়োজন। সেখানে এত সহজেই আমরা মেরে ফেলছি এক জীবন্ত বিশাল সত্ত্বাকে।

এখনও হয়তো বনটিকে বাঁচানো সম্ভব। সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষের সামান্য হস্তক্ষেপ কির্সতংকে রক্ষা করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে, জীববৈচিত্র্যকে সংরক্ষণে এমনকি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের স্বার্থেও কির্সতংয়ের সবুজ বনভূমিকে বাঁচাতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৭
এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।