এক সময় তারা ব্যাপকভাবে থাকলেও আজ সংখ্যায় কমে গেছে অনেক। পাহাড়, বন, ঝোপঝাড় এ সময় উজার হওয়ার ফলে এই পরিবারের পাখিদের বেঁচে থাকা আজ মারাত্মক সংকটের মধ্যে পড়েছে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, প্রিনারা সব ঝোপের পাখি। বাংলাদেশে সব ঝোপঝাড় শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কৃত্রিম ঝোপ হলো চা-গাছ। চা বাগানের চা-গাছগুলো কিন্তু প্রকৃতিক ঝোপ নয়। যেহেতু এটা কৃত্রিমঝোপ তাই ঝোপের পাখিরাও এখানে আছে।
আসলে আমরা চা বাগানে অনেক প্রিনাই হয়তো দেখতে পেতাম, কিন্তু এখন পাবো না, এর কারণ ঝোপগুলোতে পোকা খুবই কম। একটি ফসল হিসেবে চা গাছ লাগিয়েছি, তাই আমরা চাইনা এর পাতায় পাতায় পোকা হোক। প্রতিদিন আমরা চা গাছে কীটনাশক ছিটাই। সেই জন্যে প্রিনা পরিবারের পাখিরা কম।
‘যদি এভাবে পোকামাকড় দমনের জন্য ওষুধ না ছিটানো হতো হবে প্রতিটি চা-গাছেই একটি করে প্রিনা আপনি অনায়াসে দেখতে পেতেন। তারপরেও প্রিনারা আছে। কিন্তু আগে মতো ব্যাপকহারে আর নেই। প্রিনার সংখ্যায় ব্যাপকহারে এখনো থাকতো, যদি না চায়ের পোকাগুলোকে না মেরে ফেলা হতো। ’
এ পাখির অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, তবে চা বাগানেই প্রিনাদের আপনি দেখতে পাবেন। সম্প্রতি শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে এসে মেটেবুক প্রিনাকে (Grey-breasted Prinia) দেখে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। এছাড়াও নিরল-প্রিনা (Plain Prinia) এটিও আপনি দেখতে পাবেন। এ দু’টোই খুব বেশি পরিমাণে আছে এ এলাকায়।
‘এরা খুব ছোট্ট পাখি। একেবারে টুনটুনির চেয়েও ছোট। কিন্তু এর গলায় খুব আওয়াজ। খুব জোরে জোরে ডাকে। এ জোরে ডাকার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। জোরে না ডাকলে এরা সঙ্গীদের হারিয়ে ফেলবে। একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে ঝোপের পাখিরা সব সময় জোর গলায় ডাকার ক্ষমতা রাখে। ’
অন্য পাখির উদাহরণ উল্লেখ করে এ গবেষক বলেন, আপনি লক্ষ্য করবেন টুনটুনির (Common Tailorbird) গলাতেও কিন্তু অনেক জোর। কারণ এর পাতা থেকে পাতায় পোকার সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় এবং ছোটপাখিরা এভাবেই কিছুক্ষণ পর পর ডেকে ডেকে নিজেদের দূরত্বের অবস্থান একে-অপরকে জানান দেয়।
প্রিনাদের সম্পর্কে এই গবেষক আরও বলেন, বাংলাদেশে ৫টি প্রিনার মধ্যে সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে ৪টি প্রিনার বসবাস। এরা হলো লালচে-প্রিনা (Rufescent Prinia), হলদেপেট-প্রিনা (Yellow-bellied Prinia), মেটেবুক প্রিনা (Grey-breasted Prinia) এবং নিরল-প্রিনা (Plain Prinia)। একমাত্র সুন্দরী-প্রিনা (Graceful Prinia) ছাড়া সবগুলোই পাহাড়ি এবং চা বাগান অধ্যুষিত এলাকায় রয়েছে।
আকার-আকৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, এদের দৈর্ঘ্য মাত্র ১০ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার। ওজনেও অত্যন্ত হালকা। তবে এর লেজটি বেশ লম্বা। কেন এর লেজটি লম্বা এর তথ্য আমরা জানিনা। ঝোপঝাড়ের মধ্যে থাকলে লম্বালেজ তো কোনো কাজেই লাগে না। তাহলে এর লেজটি লম্বাই বা কেন? শুধু লম্বাই নয়, থাকে থাকে সাজানো। লেজের কেন্দ্রের দু’টো পালক বেশ লম্বা এবং পারিপাটি।
তবে আমার অনুমান হচ্ছে- এটি তাদের বিবর্তনের ধারা। কোনো এক সময় এদের লম্বা লেজ ছিল। বিবর্তনের ফলেই তা পরিবর্তিত হয়েছে।
দুঃখের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রিনাদের বেঁচে থাকার জন্য কিছুই লাগে না; সামান্য দু-চারটে পোকা। ঘাসের মধ্যেই এই পাখিটি বাসা বাঁধে। সুতরাং কারোর কোনো ক্ষতি তো করছে না, কারো কোনো ফসলও খায় না, বরং ক্ষতিকর পোকা খেয়ে উপকারই করে। প্রিনারা সবাই পোকাখেকো পাখি। তার মানে, মানুষের সঙ্গে এদের কোনো সংঘাত ছিল না। ওদের টিকে থাকারই কথা ছিল। কিন্তু আজ তারা আর টিকে থাকতে পারছে না। এর একমাত্র কারণ ঝোপঝাড় ধ্বংস
নির্বিবাদ, খুব নরম স্বভাবের এবং কারোর কোনো প্রকারের ক্ষতি করে না এমন একটি পরিবারের পাখিগুলো আমাদের দেশ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বলে জানান এই বরেণ্য গবেষক।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
বিবিবি/এসএইচ