এভাবেই কুমিরের খোঁজে সুন্দরবন চষে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন গবেষক অনিমেষ ঘোষ অয়ন।
দেশের লোনা পানির কুমিরের সংখ্যা এবং এর জীবনপ্রণালী জানতে বাংলাদেশ বন বিভাগ ও সেন্টার ফর অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন ন্যাচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কারিনামের যৌথ উদ্যোগে দু’বছর মেয়াদী গবেষণা শেষ হয়েছে।
বাংলাদেশে একসময় তিন প্রজাতির কুমির দেখা যেতো। এর মধ্যে মিঠা পানির কুমির ও ঘড়িয়াল বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। যদিও ঘড়িয়াল ও মিঠা পানির কুমির সাম্প্রতিক অতীতে দেশের নদীতে পাওয়া গেছে। একমাত্র সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইল বা লোনা পানির কুমির টিকে আছে সুন্দরবনে। এই প্রজাতিটি সম্পর্কে জানতে ‘পপুলেশন অ্যাসেসমেন্ট, প্রোটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন শীর্ষক’ এ গবেষণাটি পরিচালিত হয় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে।
মূলত দেশের বন্যপ্রাণী নিয়ে পরিচালিত বন বিভাগের এক বড় গবেষণা প্রকল্পের একটি অংশ ছিলো কুমির জরিপ। কারিনাম এটি পরিচালিত করে। গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলছিলেন প্রতিষ্ঠাটির প্রধান নির্বাহী ড. এস এম এ রশীদ।
‘লোনা পানির কুমির নিয়ে এদেশে আগে কোনো কাজই হয়নি। এ প্রজাতিটি ইতোমধ্যেই আইইউসিএনের রেড লিস্টে আছে। কোনো প্রজাতিকে বাঁচাতে হলে এর সম্পর্কে, এর সংখ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। আমাদের এ গবেষণার উদ্দেশ্য ছিলো কুমিরের সংখ্যা নিরূপণ, তাদের বাসস্থান সম্পর্কে জানা, ভবিষ্যতের জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি করা, কুমির সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি ও বন বিভাগের লোকবলকে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত করে তোলা। আমরা একটি প্রাথমিক রিপোর্ট বন বিভাগের কাছে দিয়েছি। তবে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে কুমিরের সংখ্যা কিন্তু খুবই কম। ’
১৯৮৫ সালে এক গণনায় কুমির দেড়শ থেকে দুইশো পাওয়া গিয়েছিলো বলে একটি সূত্রে জানা যায়।
মূলত ২০১৪ থেকে ১৬ সাল পর্যন্ত চলে গবেষণাটি। মাঠ পর্যায়ে এ গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন অনিমেষ ঘোষ অয়ন। ‘দীর্ঘমিয়াদী এ গবেষণায় আমরা দু’ভাবে কুমিরের জরিপ করি। এর একটি ছিলো ট্রানজেক্ট মেথডে। এটি আসলে গবেষণার পুরো সময় জুড়েই চলেছে। আর একটি ছিলো ভিজ্যুয়াল এনকাউন্টার সার্ভে। এই সার্ভে পরিচালিত হয় ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
অনিমেষ বলেন, সুন্দরবনের যেসব জায়গায় কুমির থাকার সম্ভাবনা আছে তার একটি ম্যাপ আমরা তৈরি করেছিলাম। এছাড়া বনবিভাগ একটি খাল সার্ভে করেছিলো। সে তথ্যও আমাদের কাজে লাগে। তারপর ১০ জন করে মোট ৪টি টিমে ভাগ হয়ে আমরা জরিপটি চালাই। ভারতীয় অংশে আরও ব্যাপক পরিসরে কুমির জরিপ হয়। কিন্তু আমাদের জনবল ও কারিগরি স্বল্পতার কারণে চারটি টিম করতে হয়। শীতে কুমিরের চলাফেরা থাকে কম। আবার নদীর চরে রোদ পোহাবার কারণে তাদের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। আর জরিপটি প্রথমে রাতে চালানোর সিদ্ধান্ত হলেও নিরাপত্তা সমস্যাসহ নানা কারণে আমরা দিনে করি। এর মধ্যে একবার আমাদের জলদস্যুদের গুলির মুখেও পড়তে হয়েছিলো।
বন বিভাগসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রত্যক্ষভাবে জরিপে অবশ্য ৬০টির বেশি কুমির পাওয়া যায়নি। এছাড়া পুরো গবেষণার ফলাফল বলছে সুন্দরবনে কুমিরের সংখ্যা দুশোর বেশি নয়। এ গবেষণায় কোনো কুমিরের বাসা খুঁজে পাওয়া যায়নি। উঠে এসেছে একটি বেশ নতুন তথ্যও। লোনা পানিতে বাস করলেও কুমির অতিরিক্ত লোনা পানিতে বাস করে না। এটি জানা থাকলেও গবেষণায় দেখা গেছে হলদেবুনিয়ার মতো সুন্দরবনের অতি লোনা জায়গায়ও কুমির বাস করে।
কুমির প্রজননের সময় মা কুমির কম লোনা পানিতে বাসা তৈরি করে। তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে কুমিরের লিঙ্গ নির্ধারণের বিষয়টি। কম তাপমাত্রার কারণে পুরুষ কুমির ও বেশি তাপমাত্রার কারণে মা কুমিরের জন্ম হয়।
এ গবেষণার ফলাফল নিয়ে আশবাদী বন বিভাগও। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান জাহিদুল কবীর বাংলানিউজকে বলেন, এ গবেষণায় নতুন কিছু উঠে এসেছে, যা লোনা পানির কুমির সম্পর্কে আগে জানা ছিলো না। আর সুন্দরবনে কুমিরের হুমকির জন্য দায়ী হচ্ছে অতিরিক্ত মানুষের আনাগোনা, চরপাতা জাল দিয়ে মাছ ধরা। এসবের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০১৭
এএ