ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

সবুজ নগরের বাতাসে বর্জ্যের বিষবাষ্প

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৭
সবুজ নগরের বাতাসে বর্জ্যের বিষবাষ্প সাহেব বাজার থেকে নিউমার্কেট এলাকার মূল সড়কে এভাবেই তুলে রাখা হয়েছে ড্রেনের তরল বর্জ্য

রাজশাহী: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে, বাতাস থেকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কণা কমিয়ে আনায় বিশ্বে সবার শীর্ষে ‘রাজশাহী’। গত বছরের ১৭ জুন এ তথ্য প্রকাশ করে ব্রিটিশ প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’। 

তবে সুখের এ খবর নিয়ে বছর না ঘুরতেই ধীরে ধীরে নগরের পরিবেশ আবারও বিপন্ন হয়ে উঠছে। কেবল ধুলিকণাই নয়, বাতাসে এখন ভেসে বেড়াচ্ছে বর্জ্যের বিষবাষ্প।

ড্রেনের তরল বর্জ্য তুলে রোদে শুকানো হচ্ছে খোলা সড়কের ওপরে। তাই নগরীর প্রধান সড়কগুলো জুড়েই এখন বর্জ্যের স্তুপ। ক্ষতিকারক সেই বর্জ্য শুকিয়ে ধুলিকণার সঙ্গে মিশে বাতাসের মাধ্যমে মানুষের নাক-মুখ দিয়ে ঢুকছে। ফলে বায়ুদূষণ কমানোয় রাজশাহী বিশ্বের সেরা শহর হওয়ার যে তকমা পেয়েছিল এক বছরেই সেই খ্যাতি ম্লান হতে চলেছে। আর বিষয়টি নিয়ে হালে মোটেও মাথা ঘামাচ্ছে না নাগরিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)।      

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বর্জ্য সরানোর এ প্রক্রিয়া মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে এভাবে বর্জ্য অপসারণ করা হয় না। সাধারণত তরল বর্জ্য ড্রেন থেকে ওঠানোর পর সরাসরি গাড়িতে তুলে ভাগাড়ে নিয়ে ফেলা হয় রাতের সুবিধাজনক সময়ে। আর পরিবেশ দূষণ ও নগরবাসীর সু-স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় কাজটি করতে হয় দ্রুততম সময়েই। সেখানে উল্টো নিয়মে নগরীতে কাজটি চলছে প্রায় মাস জুড়েই।

নগরীর প্রাণকেন্দ্রে থাকা সাহেব বাজার জিরোপয়েন্ট ও নিউমার্কেট সড়কে সরেজমিন দেখা যায়, ১০ থেকে ১৫ ফুট দূরে দূরে একটি করে বর্জ্যের স্তূপ। ড্রেন থেকে তরল বর্জ্য তুলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে রোদে শুকানোর জন্য। ড্রেনের তরল বর্জ্য যেনো গড়িয়ে সড়কে একাকার না হয়ে যায় সেজন্য কোথাও ছোট ছোট প্লাস্টিকের ব্যস্তা আবার কোথাও কোথাও স্তুপ করা বর্জ্যগুলো মাটি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে বর্জ্য শুকিয়ে মিশছে বাতাসের ধুলিকণায়।  

সাহেব বাজার ছাড়াও নগরীর কল্পনা হলের মোড় থেকে সাগরপাড়া হয়ে শিরোইল ঢাকা বাস টার্মিনাল পর্যন্ত এলাকার সড়কজুড়ে ড্রেনের ময়লা বর্জ্য তুলে রাখা হয়েছে একইভাবে। এতে পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি তো রয়েছে, একইসঙ্গে প্রধান সড়কগুলোয় যানবাহন চলাচলও চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানজট লেগে থাকছে। এতে সাধার মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বর্জ্য নিয়ে গত মধ্য মার্চ থেকে চলছে এ অরাজকতা।   

নগরীর নিউমার্কেট এলাকার চশমা ব্যবসায়ী মামুন হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এর আগে কখনো এতটা সময়জুড়ে খোলা সড়কে ড্রেনের বর্জ্য ফেলে রাখা হয়নি। দেখা গেছে সকালে তুললে রাতে নিয়ে গেছে। আর রাতে তোলা হলে সকালে তুলে নিয়েছে। কিন্তু এবার দীর্ঘ সময় ধরেই বর্জ্য অপসারণের প্রক্রিয়া চলায় ভোগান্তিতে পড়েছেন তারা।  

এদিকে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কনজারভেন্সি শাখা সূত্রে জানা গেছে, ‘মাঝারি শহর সমন্বিত বন্যা প্রতিরোধ প্রকল্প ফেজ-২’-এর আওতায় সাত বছর আগে একবার ড্রেন পরিষ্কার করা হয়। এবছর ৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫৬ গ্রুপে এ কাজটি হচ্ছে। গত ১০ মার্চ ৩০ গ্রুপের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ২৫ গ্রুপের কাজ চলছে। চলতি এপ্রিলের শেষদিকে বর্জ্য অপসারণের চলমান গ্রুপের কাজ শেষের কথা রয়েছে। এর পরেই বাকি গ্রুপের কার্যাদেশ দেওয়া হবে। নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের ড্রেন থেকে একই প্রক্রিয়ায় বর্জ্য অপসারণ করা হবে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই।  

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহীর সমন্বয়কারী তন্ময় স্যান্নাল বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য তারা গত সপ্তাহে সিটি করপোরেশনে গিয়েছিলেন। তারাও বর্জ্য অপসারণের এ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সংস্থার আপত্তির কথা জানিয়েছেন। কিন্তু করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাদের আশ্বস্ত করেন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ড্রেনের বর্জ্য অপসারণ করা হবে। যদিও এখন পর্যন্ত তা হয়নি।  

তন্ময় স্যান্নাল বলেন, নির্মল বাতাসের জন্য বিশ্বসেরা হওয়া রাজশাহীতে এভাবে বর্জ্য অপসারণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। বর্জ্য তুলে সরাসরি করপোরেশনের কাভার্ড ভ্যানের মাধ্যমে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে অপসারণ করা উচিত।  

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ড্রেনের বর্জ্যে মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া আছে। বাতাসে মিশে মানবদেহে ঢুকে যা বড় ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে ফুসফুস ও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া শিশুরা শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে।  

তবে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, এটি মূল সড়কের সমস্যা নয়। যেখানে এস্কেভেটর যাওয়ার রাস্তা নেই সেখানে হয়তো এভাবে বর্জ্য তুলে রাখা হচ্ছে। সেখানে অন্য কোনো উপায়ও নেই। এরপরও ছোটভ্যানে করে প্রতি রাতেই বর্জ্য অপসারণের কাজ চলছে।

আর মূল সড়কের দিনের পর দিন ড্রেনের বর্জ্য পড়ে থাকার প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি তিনি যাচাই করে দেখবেন। এমনটি  হলে সেখান থেকে দ্রুত বর্জ্য অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৭
এসএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।