শুধু গ্রামই বদলে যাচ্ছে এমন নয়, গ্রামের খাদ্যাভাসও ভীষণভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কিশোরগঞ্জ থেকে তাড়াইল পর্যন্ত প্রায় কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার পথের সাত/আটটি বাজারের দোকানে ডাবের জন্য ঢুঁ মেরে এমনই তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ পেলাম।
বদলে যাচ্ছে গ্রাম
গাছে ঠিকই ডাক আছে, দোকানে নেই কেন? কয়েকজনকে প্রশ্ন করে দুটি উত্তর জানা গেল। এক. গাছ থেকে ডাব নামানোর অভিজ্ঞ লোকের অভাব। গাছী বলে যে একটি পেশা বা বৃত্তি ছিল, সেটি প্রায়-বিলীন হয়ে গেছে। শহরমুখী ছেলে-ছোকরারা নানা টেকনিক্যাল পেশায় চলে যাওয়ায় এ কাজটি আর পারে না, গাছ থেকে ডাব নামানোর অভিজ্ঞ লোক সব সময় পাওয়া যাচ্ছে না। দুই. ডাবের চেয়ে কোমল পানীয়ের চাহিদা বেশি। বিজ্ঞাপন দেখে সবাই সেটাকে অনুসরণ করছে। ফ্যাশন বা ডাঁট দেখানোর জন্যও বোতলজাত পানীয়ের দিকে ঝুঁকছে মানুষ।
খাদ্যাভাস যে দ্রুতবেগে বদলাচ্ছে, তার আরো প্রমাণ পাওয়া গেল। স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন কোনো খাদ্য সামগ্রীই কোনো দোকানে পাওয়া গেল না। সবই কারখানার সামগ্রী। ঘরে বানানো কোনও কিছুরই দেখা পাওয়া যায় নি। সব দোকানই ভর্তি হয়ে আছে প্যাকেটজাত চিপস, চানাচুর, কেক, নুডলস, বিস্কুট ইত্যাদির বাহারী আয়োজনে।
মানুষ এখন প্যাকেটের খাবারেই চা-নাস্তা খায়। বাচ্চারাও এসব বেশি পছন্দ করে। বাড়িতে মেহমান এলেও চট দোকান থেকে প্যাকেট খাবার কিনে নেওয়া হয়, বললেন নীলগঞ্জ বাজারের দোকানি আবদুস সাত্তার। সপ্তাহে একদিন ডাব পাওয়া যায়, যখন গাছী এসে সেগুলো গাছ থেকে নামায়। ডাব শহরের দালালরাই কিনে যায় বেশি দামে। গ্রামে তাই ডাবের আকাল। বললেন তিনি।
আগে গ্রামের দিকে স্থানীয়ভাবে তৈরি পিঠা, পুলি, সন্দেশ, নাড়ু, মোয়া খাজা, গজা, বাতাসা, মুরলী ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতো। গ্রামীণ চিনি ও চালের গুড়ো দিয়ে বানানো বহু আইটেমের জন্য শহুরে মানুষ আগ্রহী ছিল। খাদ্যাভাস বদলে যাওয়ায় সেসব দ্রব্যের চাহিদা ও সরবরাহ গেছে কমে।
তাড়াইল বাজারের শেষ মাথায় এক নব্য যুবককে দেখা গেল এসব গ্রামীণ খাদ্যের পসরা সাজিয়ে নি:সঙ্গ বসে আছে। এছাড়া পুরো তাড়াইল বাজার বা শহর থেকে আসার সময় রাস্তার পাশের অন্যান্য বাজারেও ভালো করে তাকিয়ে এমন দোকান আরেকটি নজরে পড়ে নি। কথা বলে জানলাম, যুবকের নাম তোফাজ্জল। উপজেলার পূর্ব প্রান্তের কাজলা গ্রামে তার বাড়ি। এসব খাদ্য বানানো তার পৈত্রিক পেশা। মূলত ওয়াজ মাহফিল, ওরস, মেলা, পূজা, পার্বণ ইত্যাদিতে তার তৈরি খাবারের চাহিদা বেশি হয়। তিনিও তার অস্থায়ী দোকান নিয়ে সেসব স্থানে চলে যান। যখন কোথাও কোনও অনুষ্ঠান থাকে না, তখন বাজারের এক কোণে বসে থাকেন।
কেউ কেউ গ্রামে বেড়াতে এসে শহরের বাড়ির জন্য কিছু খাবার কিনে নিয়ে যান। স্থানীয় লোকজন এসব খুব একটা কেনে না। সবাই নতুন নতুন প্যাকেটের খাবার খেতে চায়। আক্ষেপে বললেন তোফাজ্জল।
বদলে যাচ্ছে গ্রাম, কথাটা শুধু উপরের কাঠামোতেই নয়। ভেতরের নানা দিকেও বদল চলছে। বহু খাবার হারিয়ে যাচ্ছে। বহু পেশা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিশোরগঞ্জ থেকে তাড়াইল আসা-যাওয়ার পথে মাত্র একজন কামার ও তালা-চাবি সারাইকারীকে দেখতে পাই। বৃদ্ধ ইউনুস মিয়ার ছেলেরা কেউ এই পেশায় আসে নি। মাঝে মাঝে তিনি কিছু কাজ পান। তাতেই কোনও রকমে তার চলছে।
গ্রামীণ সমাজ ও খাদ্যের মতো সংস্কৃতিরও বারোটা বাজছে। জারি, সারি, ভাওইয়া, ভাটিয়ালী, কবিগানের দিন আর নেই। আগে যেমন গ্রাম্য হাটের এক পাশে তাদেরকে ঘিরে লোকজন জমত, তেমন চিত্রও বিরল। সবার হাতের মোবাইলে এখন বাজছে নানা জাতের গান-বাজনা-নাটক। ঘরে ঘরে শোনা যাচ্ছে টিভির আওয়াজ।
বদলে যাওয়া গ্রাম জীবন ও সমাজ থেকে চিরায়ত সংস্কৃতি ও খাদ্যাভাসের মতোই হারাচ্ছে কুটির শিল্পজাত পোশাক। সবাই এখন রঙচঙে বিদেশি স্টাইলের কাপড়ের দিকে ঝুঁকেছে। গ্রাম শুধু গঠনগত দিক থেকেই বিলীয়মান নয়, গ্রামীণ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাদ্য, পোশাক ইত্যাদিও সঙ্কটের মুখে। তীব্র আগ্রাসী বিজ্ঞাপন ও অনুকরণে ছুটতে ছুটতে সবাই যে মূল শেকড়টিকেই ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে, সে খেয়ালও নেই!
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৭
এমপি/জেডএম