২০১৭ সালে পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছে এবং এর শিকার হয়েছে। অতিখরা, অতিবৃষ্টি, প্রলয়ঙ্করী ঝড়, তীব্র শীত, অসহনীয় তাপপ্রবাহ, করাল বন্যা ও ভূমিধস আমাদের জানিয়ে দিল জলবায়ু পরিবর্তন এক কঠিন বাস্তবতা, এক মূর্তিমান চ্যালেঞ্জ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সব রাষ্ট্রেই পড়ে। কিন্তু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরাই। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের নাগরিকরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের জমি কম কিন্তু মানুষ বেশি। তার ওপরে আবার অনেকাংশে কৃষিনির্ভর জীবন ও জীবিকা। বাস্তব কারণেই আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আবার শিল্পোন্নয়নও সময়ের দাবি। ফলে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক কারণেই আমরা দূষণের দিকে ঝুঁকছি। সেই সঙ্গে অন্যান্য বৈশ্বিক ও আনুষঙ্গিক কারণ তো আছেই।
দূষিত নগরীর মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম দিকেই। বাতাসে কার্বন। ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর প্রকাশিত The LANCET report on ‘Pollution’ বলছে, দূষণজনিত মৃত্যুর ৯২% ভাগই হয়ে থাকে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। এর কারণও আছে, শিল্পায়নে আমরা আধুনিক, লাগসই ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করছি না।
আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনেও পরিবেশ সচেতনতার অভাব প্রকট। পরিবেশ-দূষণ প্রতিরোধে আমাদের ইতিবাচক পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রের পরিবেশ কার্যক্রম এবং ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ এক কথা নয়। রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিসরে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির আলোকে আইন করছে এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এখন নাগরিক হিসেবে আমাদের এগিয়ে আসার সময়।
The list of Environmental Performance Index অনুযায়ী পরিবেশ-দূষণ রোধের ক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্তরে অব্স্থান করছি। দিনকে দিন অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। তবে আমাদের পরিবেশের এই অবস্থার জন্য কেবল যে আমরাই দায়ী তা কিন্তু নয়। আমাদের জানা আছে যে, জলবায়ু একটি বৈশ্বিক বিষয়। এর প্রভাবে কখন কোন দেশ কীভাবে প্রভাবিত হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
গত বছর দেশে যে ভয়াবহ বন্যা হয়ে গেল তার কারণ ও প্রভাবকগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ বা রাষ্ট্রীয় পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়। বন্যা যে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনেরই একটি আন্ত:রাষ্ট্রীয় প্রভাব তা অনেক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে স্বীকার করা হয়েছে । কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরাই।
জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সরকার কাজ করছে। সরকার জলবায়ু তহবিল নামে একটি তহবিল গঠন করেছে। অভিযোজনকার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সরকার কাজ করছে। এর অংশ হিসেবে জাতীয় অভিযোজন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে (National Adaptation Program of ActionNAPA-2005) । ১৯৯২ সালের কনভেনশনের (United Nations Framework Convention on the Climate Change) আলোকেই এ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় ১৫টি ভিন্ন-ভিন্ন অভিযোজন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ২০১০ সালের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের আওতায় জলবায়ু কার্যক্রমের কৌশলও নির্ধারণ করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান দায় উন্নত দেশগুলোর। বিভিন্ন কনভেনশন ও চুক্তিতে তাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। কিওতো প্রটোকলের আওতায় (১৯৯৭) উন্নত দেশগুলোর ওপর বেশকিছু দায়িত্ব বর্তেছে। এতে উন্নত রাষ্ট্রগুলো কার্বন কমাতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
কিন্তু ২০১২ সালের মধ্যে যে মাত্রায় তাদের এটি কমিয়ে আনার কথা ছিল তা অর্জনে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দোহা ঘোষণার মাধ্যমে আবার সময়সীমা বৃদ্ধি করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না।
উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে যে প্রযুক্তিসহায়তা দিতে অঙ্গীকার করেছিল তাও পুরোপুরি পালন করছে না। তাই সার্বিকভাবে জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের অর্জন আশানুরূপ নয়। কিন্তু তাই বলে আমরা থেমে নেই, থেমে থাকলে চলবেও না। নাগরিক হিসেবে পরিবেশসচেতন, রাষ্ট্র হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেই এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৬২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৮
জেএম/