রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে/ কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে/ কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে/ কুহু পাপিয়া ময়ুর বোলে/ মনের বনের মুকুল খোলে/ নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষায় প্রকৃতি ও প্রাণীকুলে পরিবর্তনে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন এমনটি।
আর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষার রূপ-ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন- ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান, মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে, এই-যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান। ’
রবি ঠাকুরের এ গানে বৃষ্টি আর কদম যেন দু’জন দু’জনের চিরদিনের মিতা। একজন আরেকজনের শুভেচ্ছাদূত।
বাদল দিনে প্রথম কদম ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক পঞ্জিকার হিসেবে আজ শনিবার (১৫ জুন) পহেলা আষাঢ়। মানে বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল অর্থাৎ বর্ষা ঋতু। এ ঋতুর প্রধান বৈশিষ্ট্য বৃষ্টি ঝরা আকাশ, কর্দমাক্ত মাঠ, নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা পানিতে পরিপূর্ণ হওয়া ইত্যাদি।
জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরম— আম, জাম, কাঁঠাল পাকার সময়। জ্যৈষ্ঠের দমফাটা গরম যেমন অস্বস্তিকর তার বিপরীতে আছে বাহারি ফলের সমাহারে মনভোলানো প্রকৃতি। এসময়টায় বাজারে প্রায় সব ধরনের ফল পাওয়া যায়। কবির ভাষায় ‘পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ’। জ্যৈষ্ঠের মধুমাস পেরিয়ে গাছে গাছে কদম ফুল ফোটে। জানিয়ে দেয় আষাঢ় আসছে। রুদ্র গ্রীষ্মের দাবদাহন শেষে প্রকৃতির রানি চিরসুন্দর শ্যামলী বর্ষার আগমনে ঘটে। কিন্তু এবছর বৃষ্টির তেমন কোনো দেখা নেই। গরম পড়ছে অবিরাম। সবাই যেন মন প্রাণ উজাড় করে সৃষ্টিকর্তার কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছে।
‘বর্ষার দূত’ কদম ফুল এরই মধ্যে ফুটতে শুরু করেছে। বর্ষার রূপ-ঐশ্বর্যে মুগ্ধ অনেক কবিই বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন। বর্ষা ঋতু তার বৈশিষ্ট্যের কারণেই স্বতন্ত্র।
প্রকৃতিতে ফুল ও ফলের সমাহার নিয়ে বর্ষা আসে। বাহারি ফুলের সুবাসে মুখরিত হয় প্রকৃতি। ফুলে ফুলে শোভিত হয় চারপাশ।
বর্ষা মানেই কর্দমাক্ত রাস্তা আর গাঁয়ের দস্যি ছেলেদের কদম ফুলকে ঘিরে হৈ হুল্লোড়। বর্ষাকে স্বাগত জানাতে এরই মধ্যে কদম ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছে প্রকৃতি। ঋতুচক্রের আবর্তনে অনেক আগেই কদম ফুল জানান দিয়েছে আষাঢ়ের আগমন বার্তা। তৃষ্ণায় কাতর বৃক্ষরাজি বর্ষার অঝোর ধারায় ফিরে পাবে প্রাণের স্পন্দন।
বর্ষা মানেই যেনো বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল। বৃষ্টির সঙ্গে কদমের ভালোবাসা খুবই নিবিড়। শুধু তাই নয়, প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশাল অংশজুড়েও রয়েছে কদমের পংক্তিমালা। তবে, নাগরিক উঠোনে সেই কদমের ঘ্রাণ, এখন অনেকটাই যেনো অতীত। নেই আর আগের মতো বিত্ত-বৈভব।
কদম ছাড়াও বর্ষায় ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বকুল, কলমি ফুল, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, গুল নার্গিস, দোপাটি, অলকানন্দ।
আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেবো মেপে। লেবুর পাতায় করমচা, ঝড়-বৃষ্টি ঝরে যা। ’ ছোট বেলায় এই ছড়া আমরা অনেকেই কেটেছি। কিন্তু এখনো অনেকেই হয়তো সেই করমচা ফলটাই দেখিনি। যদিও বর্তমান সময়ে ওষুধি এই ফলটি দেশের অনেক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে।
বর্ষার ফল করমচা। বৃষ্টিভেজা করমচা ফল, পাতা ও গাছ দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর। এখন দেশের বাজারগুলোতে বর্ষার এই ফলটি বিক্রি হচ্ছে।
বর্ষাকালের ফলগুলো পুষ্টিগুণে ভরা থাকে। পেয়ারা, লটকন, আমড়া, জাম্বুরা, জামরুল, ডেউয়া, কামরাঙা, কাউ, গাব ইত্যাদি বর্ষার ফল।
নানামুখী সৌন্দর্য ও তাৎপর্যের পাশাপাশি বর্ষায় কিছুটা বিপদের ঝুঁকিও রয়েছে। ভারি বর্ষণ বা পাহাড়ি ঢলে ভেসে যেতে পারে গ্রামের পর গ্রাম। তৈরি হতে পারে নদী ভাঙন। ভেসে যেতে পারে বেড়িবাঁধ, মাছের ঘের। সে কারণে বন্যাপ্রবণ সমতল এলাকার মানুষ আতঙ্কে পার করে বর্ষাকাল। শুধু তাই নয়, অথৈ জলের তোড়ে তলিয়ে যেতে পাবে কৃষকের আবাদি ফসলের জমিটি। আবার অতিবৃষ্টির কারণে শহুরে নাগরিকের রয়েছে জলাবদ্ধতার শিকার হওয়ার ঝামেলা। কিছু বিপদের কথা বাদ দিলে সব মিলিয়েই ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা নিয়ে আসে স্বস্তি ও শান্তির অনুভূতি। ফুলে ফলে কিংবা বৃক্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে অপরূপ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৯
এমআরএম/এএ