শুধু জলাভূমিই নয়; হিজল, করচ, হেলেঞ্চা, কলমিলতা আর বুনো ঝোপঝাড়ের ডালে ডালে পোকার সন্ধানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে ছোট পরিযায়ীরাও। ধীরে ধীরে বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এ ক্ষুদ্রাকার পাখিগুলো জানান দিয়েছে তাদের দীর্ঘ পরিভ্রমণ কাহিনী।
শীত মৌসুমে বাইক্কা বিলে পরিযায়ী পাখিদের মিলনমেলায় সবিশেষ গুরুত্বে অংশ নিয়েছে মাত্র প্রায় ১১ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের ‘বৈকাল ঝাড়ফুটকি’। এর ইংরেজি নাম Baikal Bush-warbler এবং বৈজ্ঞানিক নাম Locustella david.
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, বৈকাল হ্রদের আশপাশে এ পাখিটিকে বেশি দেখা গিয়েছিল বলে এর নামকরণ হয়েছে ‘বৈকাল বুশ-ওয়াবলার’। আর আমরা বাংলায় এর নাম রেখেছি ‘বৈকাল ঝাড়ফুটকি’। এ পাখিটি এতো দূরে থেকে শীত মৌসুমে আমাদের দেশে আসে তা আগে কারোরই জানাই ছিল না। মাত্র কয়েক বছর ধরে জানা গেছে- আমাদের দেশের শীত পরিযায়ী সে। তিনি আরও বলেন, থাইল্যান্ডে একজন বৃটিশ পাখিবিদ অনেক দিন ধরে পাখির ওপর কাজ করছেন। তিনি থাইল্যান্ডে বছর ত্রিশ আগে এ পাখিটিকে পেয়েছিলেন। আমরা কয়েক বছর ধরে পাখির জাল দিয়ে পাখি ধরে পাখিদের পায়ে রিং লাগানো উদ্যোগ নেওয়ার পরই এ পাখির সম্পর্কে জানা গেছে। ‘বৈকাল বুশ-ওয়াবলার’ লুকানো পাখি। ঝোপের একদম নিচে প্রায় মাটিতে হেঁটে হেঁটে পোকা ধরে সে। একদম অন্ধকার ঝোপের নিচে ছাড়া তাকে পাওয়া কঠিন। হঠাৎ করে যে দেখামাত্রই উড়ে পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এমনিতে চলাফেরা তার একেবারে ঝোপের মধ্যে।
হাওরাঞ্চলে পাখি নিয়ে গবেষণার বিষয়ে ইনাম আল হক বলেন, হাওর অঞ্চলে জাল দিয়ে পাখি ধরতে গিয়ে আমরা বাংলাদেশে প্রথম এ পাখিটির সন্ধান পেয়েছি ২০১২ সালে। পাখি ধরে আমরা গবেষণার কাজের জন্য পাখির পায়ে রিং পরাচ্ছিলাম তখন এ পাখিটি আমাদের জালে আটকা পড়ে। আমাদের সাধ্যে কুলাতো না এ পাখিটিকে ভালোভাবে শনাক্ত করা। বৃটিশ পাখিবিদ ও স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিলিপ রাউন্ড প্রধান গবেষক হিসেবে উপস্থিত থেকে আমাদের গবেষণার কাজের পাশাপাশি এসব পাখিদের ভালোভাবে শনাক্ত করতে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে টানা তিন বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে এসেছিলেন। ২০১০ সালে আমরা সোনাদিয়াতে পাখি গবেষণা করি। ২০১১ সাল থাকে আমরা বাইক্কা বিলে গবেষণার কাজ শুরু করি। ২০১২ সালে টাংগুয়ার হাওরেও কাজ করেছি। এ হাওরগুলোতে সুক্ষ্ম জাল দিয়ে পাখি গবেষণার কাজ করার সময় প্রায় আট-নয়টি নতুন প্রজাতির পাখি বাংলাদেশের পাখির তালিকায় আমরা যুক্ত করতে পেরেছিলাম। তাদের মধ্যে ‘বৈকাল বুশ-ওয়াবলার’ অন্যতম। ‘বৈকাল বুশ-ওয়াবলার’ পাখিটির প্রাপ্তি সম্পর্কে এ পাখিবিদ জানান, আমরা এতো লোক পাখি দেখেছি, কিন্তু কোনোদিন এ পাখিটি দেখতে পাইনি। দেশি-বিদেশি যতোই পাখি দেখে থাকি না কেন? এ পাখিটি এতোটাই লুকিয়ে থাকতে পারদর্শী যে, বাইনোকুলার দিয়ে দেখে তাদের সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু যখন জাল দিয়ে ধরা হয় তখন আমাদের হাতেই আসে, তখনই চেনা সহজ হয়। এভাবেই আমরা সেসময় প্রথম এ পাখিটিকে আমাদের বাইক্কা বিলে পেয়েছিলাম।
‘আমাদের পরের বছর আসামেও যখন পাখিটিকে প্রথম পাওয়া গেছে তখন তারা তাদের পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছিল। এখন আমরা জানি যে, ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটা জায়গায় সে শীতমৌসুমে আসে। তার মানে ভারত, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে প্রতিবছরই এরা আসে। আবার এরা গ্রীষ্মে ফিরে যায় পূর্ব রাশিয়া ও উত্তরপূর্ব চীনের তাইগা অঞ্চলে। যেখানেই তারা প্রজনন করে থাকে। ’
মিয়ানমারের কথা আমি বলছি না, কারণ ওখানে এখনও গবেষণা হয়নি, ধরা পড়েনি। তবে আমার ধারণা, এ ‘বৈকাল বুশ-ওয়াবলার’ পাখিটি নিশ্চয়ই মিয়ানমারেও যায়। আসামে আসে, বাংলাদেশে আসে। আবার থাইল্যান্ডে আসে। তার অর্থ হলো মাঝখানে অর্থাৎ মিয়ানমারে নেই কেন? নেই এজন্য যে, এখনও যেখানে পাখি নিয়ে গবেষণা হয়নি। পাখি খুঁজে দেখে সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখে পৃথিবীকে জানান দেওয়ার মানুষ নেই। এখন আমরা ধরে নিচ্ছি যে, এ অঞ্চলে ভারতবর্ষ অর্থাৎ পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলেই ‘বৈকাল বুশ-ওয়াবলার’ পাখিটি শীত কাটায় বলে জানান ইনাম আল হক।
‘টুনটুনি’ আর ‘বৈকাল ঝাড়ফুটকি’ পার্থক্য তুলে ধরে এ গবেষক জানান, এটি ‘টুনটুনি’ পরিবারের (সিলভিডি) পাখি। টুনটুনিও কিন্তু এক ধরনের ‘ওয়াবলার’ (ফুটকি) বলা যেতে পারে। তবে টুনটুনির মতো দেখতে নয় কিন্তু। টুনটুনি কিন্তু অদ্ভুত রকমের দেখতে এবং এরা লোকালয়ে থাকে। বড়-ছোট সব গাছেই থাকে। কিন্তু বেশির ভাগ ওয়াবলার (ফুটকি) তা নয়। ওরা কখনোই লোকালয়ে থাকে না, গহীন ঝোপঝাড়ে থাকে। লোকালয়ে তো ঝোপঝাড় নেই। যেখানে অনেক অনেক ঝোপ আছে মানে একত্রিত হয়ে থাকা ঘন নিচু গাছ, এ রকম জায়গাতে ওয়াবলারগুলো বসবাস করে থাকে।
‘বৈকাল বুশ-ওয়াবলার’ পাখিটিকে চেনার উপায় হলো- এর লেজের নিচে পালকগুলোর মধ্যে ঢেউয়ের মতো বাঁকানো এক সারি দাগ থাকবে। আবার গলার নিচে বুকের কাছে কালো কালো টান থাকবে। এরকম অনেক কিছু দেখে দেখে খুবই সুক্ষ্মভাবে আলাদা করতে হয়। নয়তো ‘বৈকাল বুশ-ওয়াবলার’ অন্য ওয়াবলার সঙ্গে মিশে যাবে। একটা ওয়াবলার থেকে অন্য ওয়াবলার খুব বেশি আলাদা তো না। খুব সুক্ষ্মভাবে না দেখলে এ পাখিটিকে চেনা আসলেই খুব কঠিন বলে জানান প্রখ্যাত পাখিবিদ ইনাম আল হক।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০২০
বিবিবি/আরবি/