ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

হেমন্তের শিশিরসিক্ত ভোরে শীতের হাতছানি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০২০
হেমন্তের শিশিরসিক্ত ভোরে শীতের হাতছানি মাকড়সার জালে শিশিরকণা। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: আশ্বিনের কাশ ঝরানো স্নিগ্ধ বাতাস হিম হয়ে উঠেছে কার্তিকে। মিষ্টি হয়ে উঠেছে ভোরের রক্তিম সূর্য।

রক্তরাঙা আকাশে ভোরের আলো ফুটতেই মাকড়সার জালে আটকে থাকা শিশিরবিন্দুগুলোও যেন মুক্তো দানার মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

সূর্যোদয়ের পাখি ডাকা ভোরটা হয়ে উঠেছে কুয়াশাময়। সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে ম-ম করছে মল্লিকা, শিউলি, কামিনী আর ছাতিম ফুলের সৌরভ। কুয়াশার আঁচল সরিয়ে যখন উত্তরের বাতাস বইছে-শরীরে তখন ছড়িয়ে পড়ছে শীতের হিম স্পর্শ। আর নরম রোদের আবেশ জানান দিচ্ছে শরৎ গেছে, হেমন্তের হাত ধরেই আসছে শীত।

ষড়ঋতুর এই বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য এমনিতেই সবাইকে বিমোহিত করে। এর ওপর কত বছর এমন নিয়ম মেনে শীত নামেনি তা সঠিক করে বলতে পারছেন না কেউ।  তবে করোনাকালে বায়ু দূষণ কমায় সরূপে ফিরেছে প্রকৃতি এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই একরাশ সজীব স্বপ্ন নিয়ে শীতষ্ণ প্রকৃতি যেন আবারও মানুষকে কাছে টানছে। কুয়াশামাখা প্রকৃতি আর মাঠের সোনালি ধানের ঘ্রাণে কৃষকের চোখে-মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠেছে এখনই। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে কার্তিকের পর অগ্রহায়ণ পেরিয়ে পৌষ-মাঘ শীতকাল ধরা হলেও এবার কার্তিকেই শীত শীত অনুভূত হচ্ছে।

গাছের নরম-কচি পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে মিষ্টি রোদ। মেঘমুক্ত সুনীল আকাশটাও যেন শীতের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বিকেল পাঁচটা গড়ালেই পশ্চিমে ঢলে পড়ছে সূর্য। গোধূলি লগ্নের রাঙা সূর্য সবাইকে রোমাঞ্চিত করে জলদিই নামিয়ে দিচ্ছে সন্ধ্যা। শেষ রাতের হিম শীতল বাতাস কাঁটা দিচ্ছে শরীরে। তাই কাঁথা উঠছে সবার গায়েই।  

দেশের রুক্ষ ও উত্তপ্ত এবং বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত রাজশাহীতেও আঁচর বসিয়েছে শীত। ক’দিন থেকেই শীত অনুভূত হচ্ছে। দিনের বাতাসের শুষ্কতায় টানটান হয়ে উঠছে ত্বক। রাতের আকাশে চলছে ফালি ফালি জোৎস্নার খেলা। ভোরের আলো ফুটতেই মাঠের সবুজ ধানের পাতাগুলো ভিজে উঠছে স্নিগ্ধ নীহারে। সূর্যের বর্ণচ্ছটায় শীষের ডগায় নুয়ে পড়া কাঁচের মত শিশির বিন্দুগুলো যেন প্রতিবিম্ব হয়ে উঠছে সবুজ প্রকৃতির।  বছর ঘুরে শীতের মায়াবী প্রকৃতির এমন অবয়ব এরই মধ্যে যেন বিমুগ্ধ করতে শুরু করেছে সবাইকে। দোরগোড়ায় শীত-তা টের পাচ্ছেন পদ্মাপাড়ের মানুষ।  

কৃষকের মাঠে পাকা ধানের সোঁদাগন্ধ আর সাতসকালে উত্তর থেকে বয়ে আসা হিমেল হাওয়া জানান দিচ্ছে হামাগুঁড়ি দিয়ে শীত আসছে। বাংলার অপরূপ এই প্রকৃতিতে শুরু হতে যাচ্ছে নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের চাল, পায়েস আর পিঠাপুলিতে মেতে উঠতে যাচ্ছে কৃষকের উঠোন। কালের চাকায় ভর করে আবারও সমাগত কুয়াশাচ্ছন্ন শীত।     

পদ্মাপাড়ের এই শহরে তাই এবার ভিন্ন আবহে কাটছে কার্তিক। নভেম্বরের শুরুতেই শীতের দেখা মিলেছে। যদিও আবহাওয়া অফিস বলছে, মধ্য ডিসেম্বরের আগে শীতের তীব্রতা বাড়বে না। এরপরও শীতের আগমনী বার্তায় এখনই সোয়েটার, চাদর, মাফলার বা লেপ-কম্বল নামাতে শুরু করেছেন রাজশাহীর মানুষ। অনেকে পুরোনো শীত বস্ত্র রোদে মচমচে করে শুকিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে আবার শীতের জন্য নতুন করে লেপ-তোষক বানাতে ভিড় করছেন ধুনকর পাড়ায়।  

শেষ রাতে বন্ধ হচ্ছে ঘরের সিলিং ফ্যানটিও। কেউ রাতে ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরিয়ে কমিয়েও রাখছেন। খরাপ্রবণ রাজশাহীতে গরম যেমন ভয়াবহ শীতও পড়ে তেমন। তাই শহরতলিতে যখন এমন শীতের আমেজ তখন গ্রামে-গঞ্জে হেমন্তেই যেন এসে গেছে শীত। সকাল হলেই কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে সেখানে পদধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে শীতের।  

পাখিদের ডানা ঝাঁপটানো শব্দ আর কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙাছে কৃষকদের। ভোরের হালকা কুয়াশা ভেদ করে মাঠে নামছেন তারা। বাজারে নতুন আলু, শিম, টমেটো ও মুলা উঠছে। বড় আকারের শীতালো ফুলকপি ও বাঁধাকপিতে ভরে উঠছে রাজশাহীর কাঁচা বাজার। তবে শীতের সবজির সরবরাহ বাড়লেও দামের তেজ কমছে না।  গাছিরা কোমরে রশি বেঁধে উঠে পড়ছেন খেজুর গাছে। মিষ্টি-মধুর খেজুরের রস নামিয়ে আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করছেন গুড়। ঘরে-ঘরে শুরু হয়ে গেছে নবান্নের প্রস্তুতি।  

আর গত সপ্তাহ থেকে দিনের তাপমাত্রাও কমতে শুরু করেছে। তাহলে এবছর কাঁপন ধরানো শীত নামবে কবে? আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, মধ্য ডিসেম্বরের আগে নয়। অর্থাৎ এ বছর অগ্রহায়ণের শেষে পৌষের শুরুতেই নামবে হাড় কাঁপানো শীত।  

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, মৌসুমি বায়ু এসে হিমালয় পর্বতে বাধা পেয়ে আমাদের দেশে শীত নিয়ে আসে। সাধারণত নভেম্বর মাসে এ মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঠিক সময়ে শীত শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সিএফসিসহ বিভিন্ন ওজোন গ্যাস নিঃসরণ কমে যায়। এতে বৈশ্বিক আবহাওয়ায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এবার প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়েছে। তাই নিয়ম মেনে শীত নামছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ রহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, চলতি সপ্তাহ থেকে আবহাওয়ার ধারাবাহিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গড় তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সাধারণত তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রির নিচে নামলেই শীত পড়তে শুরু করে।

তিনি জানান, দেশে ডিসেম্বর ১৫ তারিখ থেকে জানুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত শীতের তীব্রতা থাকবে। এ সময়টায় সর্বোচ্চ শীত পড়বে। এরপর থেকে আবার শীত কমতে শুরু করবে। তাই মধ্য ডিসেম্বরে রাজশাহীসহ গোটা উত্তরাঞ্চলে জেঁকে বসবে শীত।

আবহাওয়া অধিদফতরের বরাত দিয়ে আবহাওয়া কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম আরও বলেন, আগামী ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে রাজশাহীসহ দেশের উত্তরের বিভিন্ন জেলায় ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া নভেম্বর মাসে দুইটি নিম্নচাপ এক একটি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস রয়েছে। এর পর পরই পুরোদমে শীত নামবে বলেও জানান রাজাশাহী আবহাওয়া অফিসের এই আবহাওয়াবিদ।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০২০
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।