ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

পানির সঙ্গেই উপকূলের শিশুদের বেড়ে ওঠা 

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০০ ঘণ্টা, মে ২০, ২০২২
পানির সঙ্গেই উপকূলের শিশুদের বেড়ে ওঠা 

দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা থেকে ফিরে (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা): তৌফিক এলাহী সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ৫০নং গাবুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তৌফিকের বাম হাতে একটি পানির বোতল ও ডান হাতে ছোট জাল।

তাকে দেখা গেল ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ ধরে নদীর পানির দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে। কী যেন খুঁজছে সে।

তৌফিক হঠাৎ নদীতে নেমে পড়েই তার হাতে থাকা জাল দিয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির কিছু একটা শিকারের চেষ্টা করে।

শুধু তৌফিক নয়, তার মতো একই এলাকার আবু হারাইয়া (৮), নাইম (৫), জান্নাতিসহ অসংখ্য শিশুকে দেখা গেল একইভাবে শিকারে মেতে উঠতে।

তোমরা কী ধরছো, এগুলো ধরে কী করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তৌফিক বলে, পায়রা মাছের বাচ্চা। বাজারে বিক্রি করবো। প্রতিপিস দুই টাকা। টাকা দিয়ে খাবার কিনে খাই, অনেক সময় খাতা-কলম কিনি।

দিনে কত টাকা আয় হয়? জানতে চাইলে তারা জানায়, কেউ পাঁচটা পায়, কেউ ছয়টা আবার কেউ কেউ ১৫-২০টাও পায়।  

এদের মধ্যে আবু হুরাইয়া গাবুরা নিজামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আলাপকালে অনেকটা গুছিয়েই সে বলল, ‘সবাই স্কুলে যায়। অবসর সময় নদীতে পায়রার বাচ্চা ও চিংড়ির রেণু ধরে। এগুলো বাজারে বিক্রি হয়। ৫-১০-১৫ টাকা যা আয় হয়, তা দিয়েই মেটাতে হয় নিজেদের প্রয়োজনগুলো। অনেক সময় বাড়ির জন্য তরিতরকারিও কেনা লাগে এই টাকায়’।

এত অল্প বয়সে নদীতে নামতে ভয় লাগে না? জানতে চাইলে আবু হুরাইয়া বলে, আমাদের এখানে সব জায়গায় পানি। পানির সঙ্গেই বসবাস। সবাই ছোট বেলা থেকেই নদীতে ওঠানামা করে। নৌকা চালাতে পারে। আবার অন্য কোনো কাজ না থাকায় নদীতে মাছ ধরেই আয় করতে হয়। আব্বা-আম্মার সঙ্গে সবাই ছোট বেলা থেকেই রেণু ধরতে শিখে যায়। এখানে খেলাধুলা করার জায়গা তেমন নেই। তাই অবসর কাটে নদীতে পায়রার বাচ্চা বা চিংড়ির রেণু ধরেই।

আবার কারো যদি একুট খাবার খেতে ইচ্ছা করে, আব্বা-আম্মা তো টাকা দিতে পারে না, তখন আমরাই নদী থেকে পায়রার বাচ্চা ধরে বিক্রি করে খাবার খাই- যোগ করে আবু হুরাইয়া।

কোনো প্রতিকূল পরিবেশই যেন উপকূলের শিশুদের আটকাতে পারে না। অদম্য প্রাণশক্তিই তাদের বেড়ে ওঠার পাথেয়।

যার প্রমাণ মিললো পাঁচ বছরের শিশু নাইমকে দেখে। নাইম জন্মগতভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন। তার ডান পা নেই। দুই হাতের আঙুলগুলোও অসম্পূর্ণ। সমস্যা বাম পায়ের আঙুলেও। সেও দিব্যি অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে পায়রা মাছের বাচ্চা ধরতে ব্যস্ত।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত সাতক্ষীরার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা ও পদ্মপুকুরের শিশুদের শৈশব কাটছে এভাবেই।

আপাত দৃষ্টিতে স্থানীয় প্রতিকূল পরিবেশে তৌফিক, আবু হুরাইয়া, নাইমদের জীবনযাপন স্বাভাবিক মনে হলেও তাদের বিকাশ যে স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না, তা স্পষ্ট।

এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির নেতা, পরিবেশ কর্মী ও দৈনিক দক্ষিণের মশাল সম্পাদক অধ্যক্ষ (অব.) আশেক-ই-এলাহী বলেন, উপকূলের শিশুদের সবচেয়ে বড় সমস্যা তাদের খেলাধুলা ও চিত্ত বিনোদনের সুযোগ নেই। বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত হওয়ায় তাদের খেলার মাঠগুলো যেমন নষ্ট হয়ে গেছে। তেমনি চিংড়ি ঘেরের কারণে কৃষি জমি কমে যাওয়ায়ও খেলার মাঠ কমে গেছে। আগে শিশুরা ধান কাটার পর কৃষি জমিতে খেলা করতে পারতো।

তিনি বলেন, নদীর পানিতে লবণ। আগে শিশুরা নদীতে রেণু ধরে স্বাদু পানির খালে গোসল করে বাড়ি যেত। এখন স্বাদু পানির খালগুলোও নেই। ফলে লবণ পানিতে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করা বা স্বাদু পানির সংস্পর্শ না পাওয়ায় তাদের শরীরে নানা রকম রোগ বাসা বাঁধছে। একইসঙ্গে তারা অপুষ্টিতে ভুগছে। আপাত দৃষ্টিতে যেটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, সেটা আসলে স্বাভাবিক নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে তারা দিন দিন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৯ ঘণ্টা, মে ২০, ২০২২
এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।