লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের দুর্গম একটি চরে জন্ম জিহাদের। বয়স ১১ বছর চলছে।
জীবনে কখনো বিদ্যালয়ের কাছে ঘেঁষা হয়ে ওঠেনি। তৃতীয় শ্রেণি পাস খালাতো বোন সনিয়ার কাছ থেকে জিহাদ লিখতে শিখেছেন ‘মো. জিহাদ হোসেন’। তবে বানান করে বলতে পারে না নিজের নামটি। আর বাবা বা মায়ের নামও লেখা শেখা হয়নি তার। জিহাদ কখনো বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা চিন্তাও করেনি।
কারণ জিহাদরা যে চরে এবং পরিবেশে বড় হচ্ছে- সেখানকার অভিভাবকদের ভাবার সময় নেই যে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে হবে। জিহাদরা একটু বড় হলেই কোনো না কোনো পেশায় জড়িয়ে পড়ে। তাদের শিশুকাল কাটে নিজেদের পরিবারের ছোটখাটো কাজ করে। আর চরের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় বয়স ১২ বা ১৩ এর কোটায় গেলেই।
জিহাদ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেঘনা নদীর তীরবর্তী একটি চরের বাসিন্দা। মজুচৌধুরীর হাটের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে চরটির অবস্থান। ওই চরে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে মূল ভূখণ্ডে মাতবর হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। তবে চর থেকে সে বিদ্যালয়ে যাতায়াত বেশ কষ্টসাধ্য। তাই বিদ্যালয়ে আসতে আগ্রহ নেই শিশুদের।
এক দুপুরে বিস্তীর্ণ চরের মাঝখানে দেখা হয় শিশু জিহাদের সঙ্গে। তখন সে মাঠে গরু চরাচ্ছিল।
জিহাদ জানায়, সে কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি। পরিবার থেকেও তাকে বিদ্যালয়ে যেতে বলা হয়নি। তবে সে তার নামটি কাগজে লিখতে পারে। অন্য কিছু আর লিখতে পারে না।
বিদ্যালয়ে না গিয়েও কীভাবে নাম লেখা শিখেছে জানতে চাইলে জিহাদ বলে, আমার এক খালাতো বোন ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছে। তারপর তার বিয়ে হয়ে গেছে। সে আমাকে নাম লেখা শিখিয়েছে।
জিহাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিহাদের বাবা গিয়াস উদ্দিন কুমিল্লার একটি ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে আছেন। তার মা বাড়িতে কৃষিকাজ করেন। তাদের পাঁচটি গরু আছে। মায়ের সঙ্গে কৃষিকাজে সহযোগিতা এবং গরু লালন পালন করাই তার কাজ। সারাদিন মাঠে গরু নিয়ে ব্যস্ত থেকে বিকেলে চরের অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে জিহাদ। পুরো চরে তার সমবয়সী অন্তত আরও ২০ জন খেলার সঙ্গী রয়েছে, এদের কারো বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। জিহাদের বড় ভাই শরীফ (৩০) পেশায় জেলে। তিনিও কখনো বিদ্যালয়ে যাননি। তার বোন হাবিবা (১৩) তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে।
চরের ১২ বছরের পান্না, সাত বছরের হালিমা, পাঁচ বছরের পূর্ণিমা ও আট বছরের রাজিবদেরও বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।
রাবেয়া আক্তার নামে এক নারী জানান, তার তিন মেয়ে তিন ছেলে। সবচেয়ে ছোট মেয়ের বয়স প্রায় পাঁচ বছর। বড় মেয়ে নিসু আক্তারকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। ১৩ বছর বয়সেই তার বিয়ে দিয়ে দেন। দ্বিতীয় মেয়ের বয়স এখন ১২। পারিবারিকভাবে কিছুটা ধর্মীয় শিক্ষা নিলেও সাধারণ শিক্ষা নেওয়ার জন্য কখনো বিদ্যালয়ে পাঠাননি।
বলেন, চরের ছেলে-মেয়েরা চরের কাজকর্ম করেই বড় হয়। এখান থেকে কাউকে বিদ্যালয়ে পাঠানো হবে, সে পরিবেশ নেই। চর থেকে বিদ্যালয় বেশি দূরে না হলেও এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা এখনো উন্নত হয়নি। রাস্তাঘাট তেমন একটা নেই। শুষ্ক মৌসুমে ফসলি জমির পাশ দিয়ে হাঁটাচলা করা গেলেও বর্ষাকালে বড়দেররই হাঁটতে কষ্ট হয়। চলাচল করতে হয় নৌকায়। তাই আমরা আমাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর কথা চিন্তা করি না।
একই কথা জানালেন ওই চরে গত ১৫ বছর ধরে বসবাসরত মিরাজ হোসেন নামের এক কৃষক।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এ চরে ৪৯টি পরিবারের বসবাস। এসব পরিবারে বিভিন্ন বয়সী অন্তত ৫০টি শিশু রয়েছে। এরা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার মতো বয়স হলেও অভিভাবকরা তাদের বিদ্যালয়ের পাঠানোর কথা চিন্তাও করেন না। সাধারণ শিক্ষা তো দূরে থাক, ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিও বেশিরভাগ পরিবারের আগ্রহ নেই। চরের শিশুরা সকালে ঘুম থেকে উঠে গরু, ছাগল বা মহিষ নিয়ে মাঠে চরাতে যায়। কোনো কোনো শিশু কৃষিকাজে সহায়তা করে। আর একটু বড় হলে হয়ে যায় কৃষি শ্রমিক বা জেলে। আর অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই কেটে যায় চরের শিশুদের জীবন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩
এসআই