ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

দস্যু-দুর্যোগের ভয়, তবুও সমুদ্রে যেতে হয়

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৪
দস্যু-দুর্যোগের ভয়, তবুও সমুদ্রে যেতে হয় ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা উপকূলের জেলে জীবন। সমুদ্রে দস্যু আর দুর্যোগের আতঙ্ক কাটিয়ে কিনারে ফিরতে না ফিরতেই পড়তে হয় দাদনদারদের রোষানলে।

হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয় কড়ায়-গণ্ডায়। শূন্য হাতেই ফিরতে হয় ঘরে। দিন আনা দিন খাওয়া জেলে পরিবারের অবস্থা বদলায় না, এক টুকরো সম্পদ গড়তে পারেন না তারা। উপকূল ঘুরে জেলে জীবনের এইসব অনুসন্ধান করেছে বাংলানিউজ। সাত পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব-     

উপকূল অঞ্চল ঘুরে এসে: একদিকে দস্যুদের উৎপাত, অন্যদিকে ঝড়ের তাণ্ডব। এই প্রধান দুই বিপদ সামনে রেখে হাজারো জেলে জীবিকার খোঁজে সমুদ্র পথে যাত্রা করেন। বিকল্প আয়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই মানুষগুলো প্রতিনিয়ত ছোটে ঝুঁকির মুখে। বিপদ থেকে রক্ষা পেতে কোথাও আশ্রয় নেওয়ার এতটুকু সুযোগ থাকে না তাদের।

উপকূলের জেলা ভোলার দৌলতখান, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, রায়পুর, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার জেলেদের সঙ্গে আলাপকালে উঠে আসে নানা বিপদের কথা। সমুদ্রের মাছ যেভাবে জেলেদের জালে আটকা পড়ে, ঠিক সেভাবেই জেলেদের জীবন আটকে আছে সংকটের জালে। এখান থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ এদের নেই। বিপদ জেনেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জীবিকার পথ খুঁজছে এই পেশায়।

পরিসংখ্যান বলছে, উপকূলীয় এলাকায় জেলে সম্প্রদায়ভূক্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ এক হাজার। উপকূলীয় এলাকার পরিবারগুলোর মধ্যে এটি ৭ শতাংশের মতো। জনসংখ্যার বিচারে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালীতে জেলেদের সংখ্যা বেশি। জেলেদের একটি বড় অংশ সমুদ্রে মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। আর এরাই প্রতিনিয়ত দস্যু আর দুর্যোগ মোকাবেলা করে।   

ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুরে কথা হলো এফবি জাইমা নামের মাছধরা ট্রলারের মাঝি সালাহউদ্দিনের সঙ্গে। বললেন, মরন বাঁচন নিয়াই মাছ ধরতে যাই। এই ছাড়া আমাগো তো কোনো উপায় নাই। মাথার উপর থাকে আকাশ, চারপাশে থাকে পানি আর পানি। ডাকাত কিংবা ঝড়ের কবলে পড়লে আমাগো তো কিছুই করার নেই। বাঁচতে অইলে সাগরে যাইতে অইবে।

সরেজমিনে উপকূল ঘুরে জানা যায়, মৃত্যু আর নির্যাতনের ভয় ওদের তাড়িয়ে ফেরে। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব জেলেরা জীবিকার তাগিদে মেঘনায় মাছ ধরতে গিয়ে পদে পদে বিপদের মুখোমুখি হন। নদীতে দাপিয়ে বেড়ানো জলদস্যু বাহিনীর অত্যাচারে সর্বস্ব হারায় তারা। ধারকর্জ করে নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া বিচ্ছিন্ন জনপদের মানুষগুলো আবারও নিঃস্ব হয়। জলদস্যুদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত বহু জেলে জীবিকা ছেড়ে অন্য কাজে ফিরেছেন।    

ভোলার দৌলতখান উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন হাজীপুরের যেখানেই কথা হয়, সেখানেই একই অভিযোগ। ভয়াল মেঘনা দাপিয়ে বেড়ানো কয়েকটি শক্তিশালী অস্ত্রধারী জলদস্যু বাহিনীর কাছে জিম্মি ভোলার দৌলতখানের দ্বীপ ইউনিয়ন গাজীপুরের হাজারো জেলে। মেঘনা নদী বেষ্টিত এ দ্বীপের প্রায় শতভাগ মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও শুধুমাত্র জলদস্যুদের অত্যাচারে তাদের সে দিন ফুরিয়ে এসেছে। বছরে বছরে অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বারবার মুক্তিপণ দিয়ে নিঃস্ব হয়ে জেলেরা দিশেহারা।   

হাজীপুরের চর নলডগী বৈকুণ্ঠপুর বাজারে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলার সময় দস্যুদের শিকার জেলেদের নামের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকে। এক বা একাধিকবার জলদস্যুদের কবলে পড়া জেলেরা একে একে জানালেন সেই লোমহর্ষক কাহিনী। চাঁদা না দিলে নদীতে মাছ ধরা যাবে না। এটাই জলদস্যুদের আইন। প্রশাসন আর পুলিশ বাহিনীকে তোয়াক্কা না করে এরা রাতে-দিনে জেলেদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে, অভিযোগ জেলেদের।

জেলেরা জানান, নোয়াখালীর হাতিয়া উপকূলে জলদস্যুদের দাপট কমেনি। বার বার অভিযানের পর দস্যুতার ধরন বদলেছে মাত্র। এখনও প্রকাশ্য দিবালোকে সমুদ্রে জেলেদের মাছধরা ট্রলার আটক করে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ।

জলদস্যুদের নির্দিষ্ট আস্তানা নেই। আটক জেলেদের আটকে রাখা হয় সমুদ্রে ভাসমান ট্রলারে। মাছ ধরতে আগের মতোই অর্থের বিনিময়ে টোকেন নিতে হয়, তবে সেই টোকেনে ভরসা নেই। এক গ্রুপ টোকেন দিলে আরেক গ্রুপ নতুন করে টোকেন নিতে বাধ্য করে। এর ফলে জেলেরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সূত্র বলছে, মাছ ধরার দু’টি মৌসুমেই জলদস্যুদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। এজন্য দু’বার টোকেন নিতে হয়। ইলিশ মৌসুমে টোকেনের মূল্য ১০ হাজার ২০০ টাকা এবং চিংড়ি মৌসুমে টোকেনের মূল্য ১৫ হাজার ২০০ টাকা। একজন জেলেকে ধরে নেওয়া হলে মুক্তিপণ হিসাবে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং ট্রলার আটক করলে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দিতে হয়।

জলদস্যুদের আক্রমনে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকা হাতিয়ার বুড়িরচর, কালিরচর, বুড়িরদোনা, আলাদিগ্রাম, জাহাজমারা, নিঝুমদ্বীপ, সুখচর ঘুরে এসব তথ্য মিলেছে।

জেলেদের অভিযোগ, জলদস্যু দমনে বারবার অভিযান চালানো হলেও জেলেদের আতঙ্ক কাটেনি। অভিযানের পর কয়েকদিন কিছুটা শান্ত থাকলেও অল্প দিনের মধ্যেই তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। হাতিয়ার অন্তত ৮০ শতাংশ জেলে কোনো না কোনো ভাবে জলদস্যুদের আক্রমনে নির্যাতিত হয়।

হাতিয়া সদর ওছখালী থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বুড়িরচর ইউনিয়নের কালিরচর গ্রাম। এই গ্রামেই রয়েছে বুড়িরদোনা ঘাট। সরেজমিনে এই ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বহু মাছধরা ট্রলার ঘাটে বাঁধা রয়েছে। বহু জেলে আশপাশের দোকানপাটে কর্মহীন দিন কাটাচ্ছেন।

আলাপে জানা গেলো, কেউ এক সপ্তাহ, কেউ পনেরো দিন আবার কেউ এক মাস ধরে মাছ ধরতে যাচ্ছেন না। এসব জেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন।    

নিঝুমদ্বীপের আটিপাড়া গ্রামে হাঁটতে গিয়ে দেখা হয় বেশ কয়েকজন সব হারানো জেলের সঙ্গে। এদের কেউ কেউ জলদস্যুদের নির্যাতনে শুধু সর্বস্ব হারাননি, শারীরিকভাবেই কর্মক্ষম হয়ে পড়েছেন। এ কারণে দস্যুদের বিরুদ্ধে বলতে সাহস পাচ্ছেন না এরা। এদের ধারণা নাম কিংবা ছবি প্রকাশিত হলে আবারও জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হবেন।

জেলেদের অভিযোগ, জলদস্যুরা মেঘনা নদীর এক একটি এলাকা দখলে নিয়ে রেখেছে। নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কোনো জেলে জলদস্যুদের চাঁদা না দিয়ে মাছ ধরতে পারে না। চাঁদা সংগ্রহের জন্য আবার রয়েছে টোকেন পদ্ধতি। চাঁদা পরিশোধের টোকেন দেখাতে পারলে জলদস্যু বাহিনী মাছধরা ট্রলার আটক করবে না। টোকেনের মেয়াদ থাকে একমাস।

সূত্র বলছে, সময়ের বিবর্তনে জলদস্যুদের মুক্তিপণ লেনদেনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ এক্ষেত্রে অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। জেলেদের ধরে নিয়ে মোবাইল নম্বর দিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য চাপ দেয়। দর কষাকষির মাধ্যমে জেলেরা সাধ্য অনুযায়ী মুক্তিপণ দিয়ে ট্রলার মুক্ত করে আনেন। অনেকে আবার ট্রলার মুক্ত করতেই পারেন না।

জেলেদের অভিযোগ, জলদস্যুরা প্রশাসন কিংবা পুলিশ বাহিনীকে তোয়াক্কা করে না। জলদস্যু আর পুলিশের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে বলে মনে হয়। জলদস্যুদের অভিযানের সময় পুলিশের অভিযান থাকে না। অন্যদিকে জলদস্যুদের তৎপরতার কথা কোস্টগার্ড বাহিনীকে জানালে তারা ভ্রুক্ষেপ করে না।

কোস্টগার্ড ভোলা দক্ষিণ জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন সেলিম রেজা হারুন দস্যু দমনে কোস্টগার্ড সদস্যদের গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। জেলেদের নিরাপত্তায় এই বাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

অপরদিকে হাতিয়া থানার অফিসার ইন চার্জ সৈয়দ মো. ফজলে রাব্বী বাংলানিউজকে বলেন, নৌযানের অভাবে সাগরে নিয়মিত অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। সাগরে কোস্টগার্ড অভিযান চালায়। তবে এই এলাকার শীর্ষ দস্যুদের নির্ম‍ূল করা হয়েছে। বাকিরাও ধরা পড়বে পর্যায়ক্রমে।   

সিরিজের পরবর্তী পর্ব সমূহ-
দুই: জীবনভর দাদনের জালে অবরুদ্ধ যে জীবন
তিন: মাছের উৎপাদন বাড়ে, জেলেরা মাছ বেঁচে পানির দামে
চার: প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একই পেশায়, অবস্থা বদলায় না
পাঁচ: জলবায়ু পরিবর্তনে ওলট-পালট জেলে জীবন
ছয়: বিধবা জেলে বধূদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার
সাত: জেলে পরিবারের শিশু, ষোলতেই দক্ষ মাঝি 

বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।