ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

ক্ষমতাসীনদের সিন্ডিকেট, তরমুজ চাষিদের স্বপ্ন ম্লান

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৫ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৪
ক্ষমতাসীনদের সিন্ডিকেট, তরমুজ চাষিদের স্বপ্ন ম্লান

বাহেরচর, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী থেকে: বাড়তি রোজগারের আশায় হাজারো চাষি তরমুজ চাষে ঝুঁকলেও ক্ষতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে তাদের সে স্বপ্ন ম্লান হয়ে যায়। অত্যাধিক শ্রম-ঘাম আর অর্থ ব্যয়ে বছরে বছরে গরম মৌসুমের অতি দামি ফল তরমুজের বাম্পার ফলন হয়।

এই ফলন পেয়ে ধারদেনা শোধ করে চাষিরা চেষ্টা করে ঘুরে দাঁড়ানোর। কিন্তু আবাদ থেকে শুরু করে ক্ষেতের তরমুজ বাজারজাত পর্যন্ত তাদেরকে পড়তে হয় ক্ষমতাসীনদের সিন্ডিকেটের কবলে।
Rofiqul_sm
চাষিরা অভিযোগ করেছেন, তরমুজ ঢাকায় পাঠাতে গিয়ে তাদেরকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। তরমুজ পরিবহনে ট্রলি ও ট্রলার ব্যবহারে তারা প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজির শিকার। ক্ষেতের তরমুজ ঘাটে পৌঁছাতে হয় ট্রলিতে। আবার ঘাট থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে হয় ট্রলারে করে। এই দুটো যানবাহনই থাকে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে। মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর ধরেই এই অবস্থা চলে আসছে।

এই চিত্র দেশের দক্ষিণে পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার। দেশের অন্যতম তরমুজ উৎপাদন এলাকা হিসাবে পরিচিত এই এলাকার চাষিরা প্রতি বছরই তরমুজ ঢাকায় পাঠাতে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের কব্জায় বন্দি হয়ে পড়ছেন। মৌসুমে প্রতিদিন কমপক্ষে ৮০-৯০ হাজার তরমুজ রাঙ্গাবালী থেকে ঢাকায় যায়। আর একে ঘিরেই চলে সিন্ডিকেট  বাণিজ্য।
 
রাঙ্গাবালীর বিভিন্ন এলাকার তরমুজ চাষিদের সঙ্গে আলাপকালে নানামূখী সমস্যা নিয়ে কথা হলেও ঘুরেফিরে তারা ক্ষমতাসীনদের এই সিন্ডিকেট সমস্যার উপরই জোর দিয়েছেন। তরমুজ পরিবহণে সিন্ডিকেট বাণিজ্য না থাকলে চাষিরা আরও বেশি লাভবান হতে পারেন। তরমুজ চাষে বদলে যেতে পারে তাদের ভাগ্য। অথচ সিন্ডিকেটের আধিপত্যে এখন অনেক চাষি তরমুজ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চাষির অভিযোগ, সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও পটুয়াখালী-৪ আসনের বর্তমান সাংসদের লালিত রাঙ্গাবালীর কথিত মামা বাহিনীর প্রধান উপজেলা যুবলীগ সভাপতি হুমায়ন কবির তালুকদার এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেন। প্রতি বছরের মত চলতি তরমুজ মৌসুম সামনে রেখে সিন্ডিকেটের সদস্যরা চাঁদাবাজিসহ পরিবহণের নামে জোর করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

রাঙ্গাবালী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজ দেখতে পায়, এখানকার বেশকিছু চাষি এরই মধ্যে ক্ষেত থেকে তরমুজ সংগ্রহ শুরু করেছেন। দেরীতে আবাদকারীরা তরমুজ ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে চাষিরা নানামূখী সংকটে পড়ে। ক্ষেতে দেখা দেয় নানা ধরনের রোগবালাই। চাষিদের দাদনসহ ধারদেনা করে আবাদ করতে হয়। সবকিছু অতিক্রম করে পরিবহণ সিন্ডিকেট বাণিজ্যকেই চাষিরা প্রধান সমস্যা হিসাবে দেখছেন। সে কারণে চাষিদের সঙ্গে আলাপের শেষ পর্যায়েও তারা আবারও আকুতি জানিয়ে বললেন আমাগোরে বাঁচান। আমাগোরে বাঁচান।
Tarmuj_
বাহেরচর বাজার। বাচ্চু শিকদারের চায়ের দোকান। এখানেই আড্ডা বসে বেশ কজন চাষির। এদের মধ্যে বাহেরচর গ্রামের জাকির হোসেন, ফোরকান প্যাদা ও জাহাঙ্গীর মৃধাসহ আরও তরমুজ চাষি বললেন, আমরা সবই জানি। কিন্তু বললে আমাগো নিরাপত্তা কে দেবে? বলতে পারিনা বলে সবকিছুই আমাগো নিরবে সইতে হয়।

ক্ষমতাসীনদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ বাংলানিউজকে জানালে চাষিদেরকে সরকার দলের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। চায়ের দোকানে আড্ডার কিছুক্ষণ পরে কয়েকজন চাষিকে ডেকে নিয়ে নানা প্রশ্ন করা হয়। সিন্ডিকেট সদস্যরা বাংলানিউজ প্রতিবেদকের অবস্থান জানতে চেষ্টা করে।

অভিযোগ রয়েছে, তরমুজ ক্ষেত চাষের সময় থেকেই সিন্ডিকেটের তৎপরতা শুরু হয়। চাষের জন্য তারা উল্কা নামের বড় ট্রাক্টর মেশিন ভাড়া নিতে চাষিদের বাধ্য করে। তরমুজ পরিবহনে ট্রলি ও ট্রলারের মত এই মেশিনগুলোও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকে। জমি চাষ করতে হলে চাষিদের বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়ার বিনিময়ে এ মেশিন নিতে হয়। এদের ভয়ে চাষিদের কেউ কেউ রাতের আঁধারে লুকিয়ে ছোট ট্রাক্টর নিয়ে জমি চাষ করেন।       

সিন্ডিকেট বাণিজ্যের অভিযোগ প্রসঙ্গে রাঙ্গাবালী থানার অফিসার ইনচার্জ এস এম মাসুদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, এমন অভিযোগ সত্য নয়। আগে সিন্ডিকেটের তৎপরতা ছিল বলে অভিযোগ আছে। এমপির কাছে আবেদনও করা হয়েছিল। তবে আমি এখানে যোগদানের পর গত বছর থেকে সিন্ডিকেট তৎপরতা নেই।
 
সূত্র বলছে, দেশের দক্ষিণে সমুদ্র পাড়ের ছোট্ট উপজেলা রাঙ্গাবালী প্রায় পনেরো বছর আগে থেকে তরমুজ চাষের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠতে থাকে। অধিক লাভজনক হওয়ায় অন্য ফসল আবাদ বাদ দিয়ে চাষিরা তরমুজ চাষে ঝুঁকে পড়ে। বছরে বছরে ভালো ফলন হওয়ায় নজর পড়ে সিন্ডিকেটের। ক্ষমতাসীনরা বাড়তি রোজগারের আশায় পরিবহণের নামে গড়ে তোলে এই সিন্ডিকেট।

রাঙ্গাবালী উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এই উপজেলায় চার হাজার পাঁচশ হেক্টর জমিতে এশিয়ান-২, বিগ ফ্যামিলি, লং ড্রাগন, গ্লোরি ও বাংলালিংক জাতের তরমুজ চাষ হয়। তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে।


বাংলাদেশ সময়: ০০১৪ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।