ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

পরিত্যক্ত ভবনে স্বাস্থ্যসেবা!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৪
পরিত্যক্ত ভবনে স্বাস্থ্যসেবা! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মতিরহাট, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর ঘুরে এসে: পরিত্যক্ত ভবন। চারিদিকে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ।

দেয়ালে কালো আর সবুজ শ্যাওলা স্পষ্ট। ভবনের গাঁথুনি থেকে খসে পড়ছে সিমেন্টের প্রলেপ। জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় ভবনের পুরোটাই। কোনো কক্ষে গরু-ছাগলের আবাস, কোনো কক্ষে হাঁস-মুরগি। প্রথম দেখায় মনে হবে এটা শেয়াল-কুকুড়ের আবাসস্থল।

এখানে মানুষের যাতায়াত কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু না, এখানেই চলে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র হাসপাতালের কাজ।

লক্ষ্মীপুরের বিপন্ন স্বাস্থ্যসেবার একটি উদাহরণ মাত্র এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। মতিরহাট বাজারের কাছে চর কালকিনি ইউনিয়নের এ কেন্দ্রটি সরেজমিন ঘুরে এখানকার চরম দুরাবস্থা চোখে পড়ে। পাশাপাশি কয়েকটি ভবনের মধ্যে একটি কোনোমতে সচল রাখা হয়েছে বহির্বিভাগের জরুরি সেবা দেওয়ার জন্য। ওষুধ রাখার জন্য স্টোররুমের দরজা উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে। দেখেই বোঝা যায়, ধাক্কা দিলেই দরজাটি ভেঙে পড়বে। তারপরও সেখানেই রাখা হচ্ছে ওষুধপত্র।

চর শামসুদ্দিন গ্রামের বাসিন্দা মহিউদ্দিন বলেন, এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে এ এলাকার মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেও মানুষ যথাযথ সেবা পাচ্ছে না। এখানে লোকবল নেই। ওষুধপত্র থাকে না। ভবন পানিতে ডুবে থাকে।   

সূত্র বলছে, মাত্র একজন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ও একজন আয়া চালাচ্ছেন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। একজন মেডিকেল অফিসারের পোস্টিং থাকলেও তিনি কখনোই এখানে আসেননি। দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারকেও মাসে ৪-৫ দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। তারপরও এখানে বহির্বিভাগে প্রতিদিন ২০-২২ জন করে রোগী আসেন।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রধানত মা-শিশুর স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনার বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও কালকিনির এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কোনো কাজ নেই। এ এলাকার মানুষদের প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র হাসপাতালে যেতে হয়। সেখানে গিয়েও মেলে না সেবা।   

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মো. রশিদ উদ্দিন বলেন, এ ভবনে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র হাসপাতালের কাজ চালানো সম্ভব নয়। বর্ষায় ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে, মেঝেতেও পানি ওঠে। ইটের গাঁথুনি খুলে যাচ্ছে। যেকোনো সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।    

কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতাল থেকে শুরু করে এ উপজেলার তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত কোথাও ভবন আছে, ডাক্তার নেই, আবার কোথাও ডাক্তার আছে, ভবন নেই। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৫০ শয্যার নতুন হাসপাতাল ভবন হয়েছে, অথচ এখানে ৩১ শয্যার লোকবলই নেই। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য এখানে কোনো পদই নেই।

সূত্র বলছে, উপজেলার ৯ ইউনিয়নের প্রতিটিতে একটি করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৫টিতে। যেগুলো আছে, তাতে আবার জনবল সংকট প্রকট। অনেক পদে লোক থাকলেও নিয়মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান না। অন্যদিকে গোটা উপজেলায় ২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা থাকলেও আছে ২১টি। প্রতি ৬ হাজার লোকের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে বলে সরকার ঘোষণা করলেও কমলনগরে এর ব্যতিক্রম।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র হাসপাতালের ৫০ শয্যার নতুন ভবনটিও এখন প্রায় পুরোনো হতে চলেছে। অথচ সেটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে এখনও। ৩১ শয্যার জন্য যে জনবল থাকার কথা, তা-ও নেই। ৯ জন নার্সের স্থলে আছেন মাত্র ২ জন। কনসালটেন্টের সবগুলো পদই শূন্য রয়েছে। এক্স-রে মেশিন আছে, কিন্তু টেকনিশিয়ান না থাকায় সেটা কোনো কাজে লাগছে না। প্যাথলজি বিভাগ মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও আল্ট্রাসনোগ্রাম করার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই।

ভবনের দোতলায় নারী ও পুরুষ ওয়ার্ডে কোনোমতে যাওয়া সম্ভব হলেও সেখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করা সম্ভব হল না। চারদিকে পড়ে আছে ময়লা আবর্জনা। রোগীর বিছানার পাশে ময়লার স্তুপ। কবে এগুলো পরিস্কার করা হয়েছে, তার হিসাব নেই। রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনেরা এগুলো পরিস্কারের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বললেও তাতে কোনো ফল হয়নি।

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার আরিফুর রহমান জানান, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচ্ছন্নতা কর্মী অথবা সুইপার বলে কোনো পদ জনবলের তালিকায় নেই। কী কারণে এ পদটি বাদ পড়ল তা তিনি জানাতে পারেননি। নতুন ভবন উদ্বোধন আর ৫০ শয্যার লোকবল নিয়োগ করা হলে সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।

মাঠ পর্যায়ে, বিশেষ করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো পরিচালিত হয় সরকারের দুই বিভাগের মাধ্যমে। দুই বিভাগের লোকজনই থাকেন এই কেন্দ্রে। এ কেন্দ্রে একজন ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার, ২ জন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো), একজন এফডাবিøউভি, ৫ জন এফডাবিøউএ, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন আয়া ও একজন পিওন থাকার কথা। এর মধ্যে কিছু জনবল স্বাস্থ্য বিভাগের, আর কিছু পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের। কিন্তু অধিকাংশ কেন্দ্রে অধিকাংশ জনবলই নেই।

মাঠের সরেজমিন তথ্য সূত্র বলছে, মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবায় রয়েছে সরকারের তিন বিভাগ। স্বাস্থ্য বিভাগ এবং পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সঙ্গে আবার রয়েছে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। বিভাগগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকায় স্বাস্থ্যসেবায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিভাগে জনবল কম থাকা এবং ভবনের সমস্যার কথা স্বীকার করলেন কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিষয়গুলো উর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়েছে। অচিরেই হয়তো সমস্যার সমাধান হবে।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিনে ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]


বাংলাদেশ সময়: ০১০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।