ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

নাফ তীরের জেলেদের দু:সময়!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৫
নাফ তীরের জেলেদের দু:সময়! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ, (কক্সবাজার) ঘুরে এসে : হতাশা-গ্লানি জীবন ছুঁয়ে যায়। পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করেও পারছে না।

নদীতে মাছ কমে গেছে। তিনবেলা ভাতের যোগাড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ভাঙণে হারাচ্ছে বাড়িঘর। অভাব-অনটনের কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এর ওপর খাবার পানি, চিকিৎসা, যাতায়াতের কষ্ট তো আছেই।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদীর তীরের জেলেদের এমনই দুঃসময় এখন। জোড়াতালির চালা-বেড়ায় বিপন্ন বসতি এদের। এর ভেতর দিয়ে উঁকি দেয়া একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নটা যেন বার বারই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ঝড়ে বাড়িঘর ভাঙে, আবার মাথা তুলে এখানকার মানুষেরা। নাফ নদীর ভাঙণ আঘাত করে ঘরের ভিটেয়, আবার নতুন করে তৈরি হয় ঘর। কিন্তু নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় এখানকার জেলেরা সেই সংগ্রাম আর চালিয়ে নিতে পারছেন না।

সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ার মানুষের মুখে এই সংকটের কথাগুলোই বার বার ঘুরপাক খায়। পাড়ার প্রবেশ পথে ফরিদ আহমদের চায়ের দোকান কিংবা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সামনের হোটেল, যেখানেই আলোচনা হল, সবার মুখে যেন একই কথা। ন্যুনতম নাগরিক সেবা এদের ভাগ্যে জুটে না।

আবদুল আমিন। শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ার জেলে। নদীর তীরে খাস জমিতে ঘর বেঁধে দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করছেন। নাফ নদীতে মাছ ধরাই তার একমাত্র জীবিকা। কিন্তু দিনে দিনে মাছ কমে যাওয়ায় জীবিকায় দেখা দিয়েছে নানা সংকট। আমিন বলেন, নাফ নদীতে মাছ ধরে আগে আমরা অনেক ভালো ছিলাম। এখন সংসার চালিয়ে নিতেই কষ্ট হয়।

আরেকজন আবদুল গনি। একই পেশায় দিন চলছে বহুদিন। জানালেন, আগের মত মাছ পড়ে না নাফ নদীতে। মায়ানমারের জেলেরা বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদীর মোহনায় লাইট জাল দিয়ে মাছ ধরার ফলে নাফ নদীতে মাছ ঢুকতে পারছে না। নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

শাহপরীর দ্বীপের জেলেদের অভিযোগ মায়ানমারের জেলেদের বিরুদ্ধে। নাফ নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরের স্বচ্ছ পানিতে লাইট জাল ফেলে মাছ ধরে মায়ানমারের জেলেরা। মাছধরার কয়েকটি নৌকা একত্রিত হয়ে একসঙ্গে ৪০-৫০টি লাইটের আলো ফেলে সমুদ্রের পানিতে। তখন মাছ ছুটে আসে আলোর দিকে। জেলেরা চারিদিকে জালের বেরিকেড দিয়ে মাছ ধরে ফেলে। ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত এই তৎপরতা চলে।

জেলেরা আরও অভিযোগ করেন, জাহাজে করেও বঙ্গোপসাগরের এই এলাকায় মাছ ধরা হয়। এগুলো ট্রলিং নামে পরিচিত। নাফ নদীর মোহনা থেকে এই ট্রলিংগুলোর ৫০ বাহুর ভেতরে মাছ ধরার কোন নিয়ম নেই। অথচ এগুলো ৬ বাহুর মধ্যে এসে মাছ ধরে। নাফ নদীতে মাছ প্রবেশ করতে না পারার এটাও অন্যতম কারণ বলে জেলেদের অভিমত।

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপের একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে নাফ নদী। দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ মাছধরার ওপরই নির্ভরশীল। আবার এই জেলেদের একটি বড় অংশ নাফ নদীতে মাছ ধরে। কারও অবস্থাই এখন ভালো নয়। সবারই যাচ্ছে দুঃসময়। বাজার পাড়া, মিস্ত্রি পাড়া, মাঝের পাড়া, ডেইল পাড়ার জেলেরা বলেন একই কথা। নাফ নদীতে আগের মত মাছ নেই।

শাহপরীর দ্বীপের প্রবেশ মুখেই জালিয়াপাড়া। অন্তত এক হাজার জেলের বসবাস এখানেই। নাফ নদীর তীর ঘেঁসে পরিবারগুলোর বসবাস। এপারে এক দেশ, ওপারে আরেক দেশ। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া নাফ নদীতে মাছ ধরেই এখানকার জেলেদের জীবিকা। নাফ তীর ঘুরে সহজেই অনুমান করা যায়, এ নদী শান্ত নয়। ভাঙণে জালিয়াপাড়ার অনেকটাই হারিয়ে গেছে। শতবর্ষী বটবৃক্ষ, মসজিদ, কবরস্থান নাফের গ্রাসে হারিয়ে গেছে। ভাঙণ কবলিত পরিবারগুলো এখন শংকায় রয়েছে।

নদীর তীরে দেখা হল পাড়ার জেলে নূরুল ইসলামের সঙ্গে। সূর্যটা তখন পশ্চিমে হেলেছে। নূরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার কথা বলার সময় নেই। তবু দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিটের আলাপ। তারও একই অভিযোগ। মায়ানমার জেলেদের লাইট জাল নাফতীরের বাংলাদেশি জেলেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে।

শাহপরীর দ্বীপের এই জালিয়া পাড়াটি সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। এই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুস সালামেরও একই অভিযোগ। মায়ানমারের জেলেদের লাইট জালের তৎপরতা বন্ধ করতে না পারলে নাফ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারীদের এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। এরই মধ্যে অনেক জেলে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজছেন।

তবে সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্জ হামিদুর রহমান জেলেদের এই অভিযোগের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে পারলেন না। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মায়ানমারের জেলেরা মাছ ধরলেও তাতে শাহপরীর দ্বীপের জেলেদের ততটা ক্ষতি হচ্ছে না। এদের জীবন-মান উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যতটা সম্ভব সহায়তা করা হয়।                     

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০০০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।