ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

মাতারবাড়িতে রোজগারে ভাটা, ব্যবসায় মন্দা

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫
মাতারবাড়িতে রোজগারে ভাটা, ব্যবসায় মন্দা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মগডেইল, মাতারবাড়ি, মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন প্রায় আড়াইটা। তবু মগডেইল গ্রামের বহু মানুষের চোখে ঘুম নেই।

অনেকের দৃষ্টি টিভির পর্দায়। একের পর এক চলছে ছায়াছবি।

এদের ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মাঠে কাজের ব্যস্ততা নেই। নেই অন্য কোনো কাজ। বেকার সময়টা পার করতেই তাই রাত জেগে টিভির সামনে বসে থাকা কিংবা দোকানে আড্ডা।

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি ইউনিয়নের মগডেইল গ্রামের বাজারের এক চায়ের দোকানে রাত আড়াইটার দিকে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপ হয় কয়েকজনের।

এদের একজন জাহাঙ্গীর আলম। বাইরের আগন্তুক দেখে কথার বন্যা ছোটে ক্ষুব্ধ এই লবণ চাষির। বলতে থাকেন অনেক কথা।

অন্যান্য বছর এই সময়টাতে অন্তত ১০০০ কিংবা ৫০০ টাকার নোট থাকে প্রায় সবার পকেটেই। কিন্তু এবার পকেট তো ফাঁকাই, ঘরে তিনবেলা চাল কেনার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই অনেকের। তাই বেকার সময়ে রাত-বিরাতে চায়ের দোকানে।

এমন আরো কয়েকটি দোকান এই বাজারে। রাস্তায় হাঁটলে কানে বাজে ছায়াছবির জোরালো আওয়াজ। কখনো হাততালি, কখনো বা সিনেমার প্রিয় চরিত্রের জন্য আফসোস। এভাবে কখনো কখনো রাত পোহায়। কখনো বা শেষ রাতে ঘুমাতে যায় সবাই। অন্যান্য বছর দীর্ঘ সময় দোকানে বসে থাকার সময় কারো হাতেই ছিল না।

জাহাঙ্গীর আলমের সোজাসাপ্টা জবাব, ভাই কাজ নাই। টাকা নাই। টাকার চিন্তায় ঘুমাতে পারি না। সংসারের নিত্যপ্রয়োজন মেটাতে পারি না।

আরেকজন বলেন, লবণ মাঠ ফাঁকা পড়ে আছে বলে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য সবই বন্ধ হওয়ার পথে। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। বহু বছর ধরে নিজের জমিতে লবণ চাষ করে জীবিকা নির্বাহকারীদের অনেকেই কাজের সন্ধানে শহরে ছুটছে।

মগডেইল গ্রামের বাজার ঘুরে দেখা গেল, সেখানে ছোটখাট সব ধরণের ব্যবসায় মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বেচাকেনা না থাকা এবং মোটা অংকের বকেয়া পড়ে থাকায় অনেকে দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার সামান্য পরিমাণ পণ্য নিয়ে দোকানে বসে আছেন কিছু বিক্রির আশায়।

মগডেইল বাজারের অনেক পুরানো মুদি দোকানি মো. তাজুমদ্দিন। ১৭ বছর ধরে এই ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৭২ টাকা বকেয়া পড়ে তার দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে নিজে দেনা আছেন ৭২ হাজার টাকা। সিদ্দিক আহম্মদের দোকানে গিয়ে দেখা গেল কোনো মালামাল নেই। সামান্য পরিমাণ মালামাল থাকলেও তা কেনার লোক নেই।

মো. তাজুমদ্দিন বলেন, এই বাজারের সব ব্যবসা-বাণিজ্য আবর্তিত হতো লবণ চাষকে ঘিরে। মানুষের হাতে টাকা থাকলে তারা দোকান থেকে নগদ টাকায় মালামাল কেনেন। টাকা না থাকলে বাকিতে নেন। একেবারেই হাত ফাঁকা হয়ে গেলে সে দেনা আর শোধ করা সম্ভব হয় না। লবণের ভরা মৌসুমে এই বাজারসহ পাশের অন্য বাজারগুলোতে বেশ ভালো বেচাকেনা হয়। এবার একেবারেই ঝিমিয়ে পড়েছে।  

বাজার ঘুরে জানা গেল, এখানকার আবদুল মান্নান নামের একজন পান-সুপারির দোকান দিতেন। বেচাকেনা না থাকায় দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। তাজেম উদ্দিন তার মুদি দোকান বন্ধ করে দিয়ে এখন বেকার। আবু মুসার মুদি দোকান ছিল। এক লাখ ২০ হাজার টাকা বকেয়া থাকা অবস্থায় দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। চা দোকানদার আলাউদ্দিনের দোকানও বন্ধ। এখন বেকার। নওশাদুল ইসলামের ওষুধের দোকান ছিল, বেচাকেনা না হওয়ায় তিনিও বন্ধ করে দিয়েছেন।

বাজারে পানের দোকান করতেন শেফায়েত উল্লাহ। বেচাকেনা না হওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিয়ে সীতাকুন্ডের শিপব্রেকিংয়ে কাজে গেছেন। ওবায়দুল্লাহ বাজারে মুদি দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দোকান বন্ধ করে দিয়ে স্ত্রী-কণ্যাসহ চট্টগ্রাম চলে গেছেন। আবুল কাসেমের মুদি দোকান ছিল। এখন তিনি বেকার। মোকতার আহমেদের ছিল মুরগির দোকান। দু’মাস আগে দোকান বন্ধ করে দিয়ে চট্টগ্রাম চলে গেছেন। বাজারের পান দোকানি সোহেল রানা ব্যবসা ছেড়ে শিপব্রেকিংয়ের কাজে গেছেন।

এলাকার বয়োজেষ্ঠ্যদের মধ্যে অন্যতম সৃজনী কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড প্রি ক্যাডেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমি এলাকার মানুষের মধ্যে একটা হা-হুতাশ দেখি। এখানে কাজের অভাব তীব্র আকারে ধারণ করেছে। অভাব-অনটনের কারণে অনেকেই এলাকা ছেড়ে বাইরে চলে গেছে কাজের খোঁজে। অথচ এই এলাকার মানুষের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিল লবণ চাষ।

আলাপ হলো বেসরকারি ঋণদানকারী সংস্থা আশার সিনিয়র লোন অফিসার এম আলী মোরশেদের সঙ্গে। মগডেইল গ্রামে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, আগে এ এলাকার লোকজন টাকা দিয়েছে। আমরা টাকা নিয়েছি। এখন তারা টাকা দিতে পারছে না। লবণ চাষ করতো বলে অনেকের পক্ষেই টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল। এখন তো লবণের মাঠ ফাঁকা পড়ে আছে। কারও হাতেই কাজ নেই। এই গ্রামে আশার প্রায় আড়াই লাখ টাকা ঋণ বকেয়া রয়েছে বলে জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মগডেইল ও আশপাশের গ্রামে কর্মরত বেসরকারি অন্যান্য ঋণদানকারী সংস্থা গ্রামীণ ব্যাংক, প্রত্যাশী, বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি, ব্র্যাক ও রিকের অবস্থাও একই রকম। তাদের কয়েক লাখ টাকা ঋণ বকেয়া পড়ে আছে। প্রতিদিন বকেয়া লোনের তাগাদা চলতে থাকলেও বকেয়া উত্তোলনের পরিমাণ একেবারেই কম।     

মাতারবাড়ি ইউনিয়নের মগডেইল গ্রামে বৃহৎ কয়লা বিদ্যু‍ৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানকার জমি হারানো মানুষেরা একদিকে লবণ চাষ করতে পারছেন না, অন্যদিকে ক্ষতিপূরণের টাকাও না পাননি। এর ফলে তারা কাজ হারিয়েছেন। আর অন্তত ২০ হাজার মানুষ কাজ হারানোর ফলে এলাকার দৃশ্যপটই বদলে গেছে।   
 
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০১২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।