ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

নদীতে ‘অবরোধ’, কর্মহীন মানুষের ভিড়

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২০ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৫
নদীতে ‘অবরোধ’, কর্মহীন মানুষের ভিড় ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হাজীরহাট, মনপুরা (ভোলা) থেকে: নদীতে মাছ ধরা বন্ধ, তাই উপকূলীয় এলাকার গ্রামগুলোতে কোনো কাজ নেই। শুধু জেলে নয়, মাছধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী, শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, এমনকি ক্ষুদ্র চা-পান দোকানিদের জীবনেও স্থবিরতা নেমে এসেছে।



কমে গেছে নিত্যদিনের আয়-রোজগার। শহরে গিয়েও কাজ মিলছে না। কাজের খোঁজে শহরমুখী মানুষগুলো আবার গ্রামে ফিরেছেন। চড়া সুদে ধারদেনা আর সঞ্চয় ভেঙে দিন চলছে উপকূলের প্রান্তিক জনপদের মানুষের।

দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরা উপজেলার হাজীরহাট, সিরাজগঞ্জ, জনতা বাজার, রামনেওয়াজ এলাকায় মানুষের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য মিলেছে।

বর্ষায় এসব অঞ্চলে কর্মজীবী মানুষের কোলাহল থাকলেও এখন প্রায় জনশূন্য। ছোট বাজার কিংবা ঘাটে বহু দোকানপাট সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। গ্রামে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অস্বাভাবিক।

চলতি মাসের পয়লা তারিখ থেকে মেঘনাসহ উপকূলের কয়েকটি নদীতে মাছধরা বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। জেলেরা এই নিষেধাজ্ঞাকে বলে ‘অবরোধ’।

এই নিষেধাজ্ঞা চলবে দু’মাস। এর আগেও কয়েক ধাপে মাছধরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে মাছধরা পেশায় নিয়োজিত বহু মানুষের জীবনে নেমে এসেছে সংকট।

শুধু মনপুরা থেকেই অন্তত ২০ হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেছেন বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।  

মনপুরা হাজীরহাট পল্টুনের কাছে চায়ের দোকানে আলাপ হয় মো. সেলিম মাঝির সঙ্গে। মাছধরা ধরা বন্ধ থাকায় তিন সদস্যের সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

এ সময়ে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে নিয়েছেন প্রায় দশ হাজার টাকা। প্রতি হাজারে ছয় মাসে সুদ গুনতে হচ্ছে ৫০০ টাকা। নিষেধাজ্ঞা শেষে জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে নামতে ঋণ লাগবে আরও কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা।

মনপুরার চর যতীনের জেলে মো. ইউসুফ বাংলানিউজকে বলেন, ৪-৫ মাস ধরে কাজ নেই। ঘরের ৬ সদস্যের মুখে ভাত তুলে দেওয়াই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। কর্মহীন এই সময়ে মহাজন আর এনজিওর কাছে দেনা করেছেন প্রায় ২০ হাজার টাকা।

‘মাছধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এবার সরকার থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাইনি। গতবার পেয়েছি মাত্র ৩০ কেজি চাল। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির তূলনায় এ সহায়তার পরিমাণ অত্যন্ত কম,’-যোগ করেন তিনি।

হাজীরহাট ঘাটের শ্রমিক মো. ইলিয়াস। বাড়ি চরজ্ঞান। নদীতে মাছধরা বন্ধ থাকায় তার জীবিকায় নেমে এসেছে সংকট। ঘাটে কাজ করে দৈনিক যা পেতেন, তা দিয়ে চলে যেত সংসার।

বললেন,এখন সে অবস্থা আর নেই। ভরা মৌসুমে যেখানে রোজগার হয় ৩-৪শ’ টাকা, সেখানে এখন দিনে সর্বোচ্চ মেলে ৫০ টাকা। সংসার চালিয়ে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

ঘাটে যখন যে কাজ পাওয়া যায়, তা-ই করেন শ্রমিক আবদুল মালেক। দৈনিক যে টাকা পাওয়া যায়, তা দিয়ে দিনের হাত খরচই হয় না। ধার-দেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে।

মালেক বলেন, এই এলাকার কাজ-কর্ম নির্ভর করে নদীতে মাছধরার ওপর। মাছধরা বন্ধ থাকলে সব ক্ষেত্রেই ভাটা পড়ে।

হাজীরহাট পল্টুন ঘাটের কাছে বরফকলে চাকরি করেন মো. কাঞ্চন মিয়া। জানালেন, মাছ না থাকায় বরফ কলটি এখন লোকসানে। ৫ মাসে লোকান হয়েছে ৪-৫ লাখ টাকা। বরফকলের ৬জন স্টাফের বেতন দিতে পারছেন না মালিক। স্টাফদের মধ্যে কয়েকজন অন্য কাজের জন্য ছুটেছেন।

চরফ্যাশনের বেতুয়াঘাটে কিনারে তুলে রাখা বেশ কয়েকটি মাছধরা ট্রলার। কিছু মানুষ জাল-নৌকা মেরামতের কাজ করছে। নদীতে দু’একটি মাছধরা নৌকা চোখে পড়ে। একইভাবে ঘাটের আশপাশের দোকানেও লোকজনের তেমন ভিড় চোখে পড়ল না। অথচ বর্ষাকালে এই এলাকা হাজারো কর্মজীবী মানুষের কোলাহলে মুখর থাকে।

বেতুয়া থেকে ছোট লঞ্চে মনপুরার জনতা বাজারে গিয়েও চোখে পড়ে একই অবস্থা। কর্মহীন জেলেদের অলস সময় কাটছে। অনেকে চলে গেছেন বাইরে।

চরফ্যাশনের সিরাজগঞ্জ বাজারে বহু বন্ধ দোকানপাট চোখে পড়ল। ভরা মৌসুমে এই দোকানগুলোতে অসংখ্য মানুষের ভিড় থাকে। একই অবস্থা চরজ্ঞানে।

কর্মব্যস্ত জেলেরা হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে আছেন। বাকিতে সওদাপাতি এনে দেনার বোঝা বাড়িয়ে তুলছেন। ঘরে সামান্য পরিমাণ সঞ্চিত টাকা এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে।

এদিকে বিশেষ সময়ে নদীতে মাছধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও জেলেদের জন্য পুনর্বাসন সহায়তা একেবারেই কম বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রতিবছর এই সহায়তা দেওয়া হলেও সব জেলের কাছে তা পৌঁছায় না। সহায়তা বিতরণে দলীয়করণের অভিযোগও রয়েছে।

মনপুরার হাজীরহাটের বাসিন্দারা অভাবের মৌসুমে এলাকায় কয়েকটি প্রকল্পে কাজ চললেও সেখানে কর্মহীন মানুষের কাজের সুযোগ খুবই কম। বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বাঁধ সংরক্ষণে নদী তীরে ব্লক ফেলানোসহ অন্যান্য কাজে এলাকার মানুষদের কাজের সুযোগ না দিয়ে বাইরে থেকে শ্রমিক আনা হচ্ছে।                        

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad