ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলে সংকটে শৈশব-২

পুতুল খেলার বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১৫
পুতুল খেলার বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হাজারো সংকটে ঘেরা উপকূলের শৈশব। এ এক অন্যরকম বেড়ে ওঠা।

এখানে শৈশব ডানা মেলে অপুষ্টি আর অশিক্ষায়। দূরন্তপনার রেশ কাটতে না কাটতেই হয় কর্মজীবনের সূচনা। কাঁধে ভর করে সংসারের বোঝা।

এখানকার শিশুদের জীবনকে আলোড়িত করে না শৈশবের রঙিন কোনো স্বপ্ন। দারিদ্র্যতার বেড়াজাল নিয়ে আসে কেবল বঞ্চনার পর বঞ্চনা। শিশু অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। পেটভর্তি খাবারের আয়োজনটা ঠিকঠাক না থাকলেও হাড়ভাঙা পরিশ্রমটা রয়েছে পুরো মাত্রায়।

উপকূলের প্রান্তিক জনপদের শিশুদের সংকটের আদিঅন্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে বাংলানিউজ তৈরি করেছে ‘উপকূলে সংকটে শৈশব’ শীর্ষক ছয় পর্বের ধারাবাহিক। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে এসে: শিশুবঁধূর মায়ের কাছে প্রশ্ন-এতো অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিলেন কেন?

জবাব এলো, ‘ডাঙর (বড়) মাইয়া ঘরে রাখা নিরাপদ না। মোরা চরে ক্যামনে থাহি কেউ খোঁজ নেয় না। ’

আরেকজন শিশুবঁধূর মায়ের জবাব, ‘ঘরে তিনবেলা খাবার যোগাড় করতে পারি না। মাইয়া বিয়া দিতে পারলে খরচ কমে। এক মাইয়ার পিছনে তো অনেক খরচ। কোথায় পামু টাহা-পয়সা। ’

দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরা উপজেলার চর কলাতলীর দুই অভিভাবকের কথা থেকে বোঝা গেল প্রধানত নিরাপত্তাহীনতা আর দারিদ্র্যতার কারণেই বাল্যবিয়ে হচ্ছে দ্বীপের গ্রামে। আইন-কানুন অনেক থাকলেও এই প্রান্তিক জনপদে তা প্রযোজ্য নয়। শিশু বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। একইভাবে ছেলেরাও বিয়ে করে শিশু বয়সেই।
 
ভোলার দুর্গম দ্বীপ কলাতলীর চার নম্বর আবাসন এলাকায় আঞ্জল হক ব্যাপারীর দোকানে চায়ের টেবিলে পাঁচ কিশোর। বয়স দেখে প্রথমে প্রশ্ন আসে তারা পড়াশুনা করছে কি না? জানা গেল, কারও লেখাপড়াই তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির বেশি এগোয়নি। এলাকায় শিশু বয়সে বিয়ে নিয়ে আলাপ উঠতেই ওই কিশোরদের কাছে আবার প্রশ্ন। জানা গেল, পাঁচ কিশোরের মধ্যে চার জনই  বিবাহিত। দু’জনের আবার সন্তানও রয়েছে।

হেলাল উদ্দিন (২০)। বাবা আবদুল মান্নান। বিয়ে করেছে চার বছর আগে। বিয়ের সময় বয়স ছিল ১৬ বছর। স্ত্রী মিনারা বেগমের বয়স তখন ছিল ১৪ বছর। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই এই দম্পত্তির ঘরে এক ছেলে সন্তান আসে। আরেকজন শরীফ (১৯)। বিয়ে করেছে দু’বছর আগে। স্ত্রী মর্জিয়া বেগমের বয়স ছিল তখন মাত্র ১৫ বছর। এই দম্পতির এক সন্তান রয়েছে। আরেকজন হোসেন (১৮)। মাত্র একমাস আগে বিয়ে করেছে। স্ত্রী ফারজানা বেগমের বয়স ১২ বছর। বিয়ের পর থেকে ফারজানা নানান অসুখে আক্রান্ত।

মর্জিয়া বেগমের মা রোকসানা বেগম বলেন, বাড়ি ছিল হাতিয়ায়। নদীভাঙনে সব হারিয়ে এই চরে এসেছি। আয়-রোজগারের লোক নেই। অসুস্থতার কারণে স্বামী আবদুল করিম কাজ করতে পারে না। দুই মেয়েকে ঘরে রাখার মত কোনো ব্যবস্থা নেই। বড় মেয়ে ঘরে রাখায় নিরাপত্তা নাই। ধারকর্জ করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। ৩০ হাজার টাকার মত দেনা আছি। এই টাকা কিভাবে শোধ করবো জানিনা।

কিশোর হেলাল উদ্দিনের বাবা আবদুল মান্নান বলেন, বাড়ি ছিল মনপুরায়। সব হারিয়ে পাঁচ বছর আগে এখানে এসেছি। ছেলে বাইরে কাজকর্ম করে। ঘরের কাজ সামলাতে সমস্যা হয় বলে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি। ছেলের ব্যবসার জন্য মেয়ের বাবা কিছু টাকা দিয়েছে।

উপকূলের এইসব প্রান্তিক জনপদে ১৪-১৫ বছর পার হতে না হতেই মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে। ছেলেদেরও বিয়ে হচ্ছে ১৭-১৮ বছরের মধ্যে। বিয়ের আগে ছেলের দরদাম ওঠে। ছেলের বাবা রাজি থাকলে ২০ কিংবা ২৫ হাজার টাকায় বিয়ে সম্পন্ন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ৬-৭ টাকা খরচ হলে বাকি টাকা ছেলের পুঁজি। অল্প বয়সে এই বিয়ে ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে এ দুর্গম এলাকায়।

ভোলার মনপুরা উপজেলার চর কলাতলীর একাধিক গ্রাম ঘুরে শিশু বিয়ের এমন আরো চিত্র মেলে। যে বয়সে ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজে থাকার কথা, সে বয়সে তারা সন্তান নিয়ে সংসার সামলাচ্ছে। সংসারের কাজের ভারে কিশোরীদের শরীর ভেঙে পড়েছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগবালাই। অল্প বয়সে আসা সন্তানও বেড়ে উঠছে অপুষ্টি নিয়ে। অন্যদিকে কিশোর বয়সে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে ছেলেটির জীবনও যেন বিপন্ন।

চর কলাতলীর শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, উন্নয়নকর্মী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, এই চরের প্রায় সব বাড়িতেই অল্প বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। অসচেতনতা, দারিদ্র্যতা আর নিরাপত্তাহীনতা এর অন্যতম কারণ। দরিদ্র অভিভাবক তার বয়সী মেয়েকে ঘরে রাখতে পারে না। কোনভাবে দুর্নাম রটে গেলে মেয়ের বিয়ে হবে না, এই ভেবে বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ের কথা ভাবতে থাকেন অভিভাবকেরা।

চর কলাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নাজমুল হুদা বাবুল বলেন, এলাকার লোকজন খুব একটা লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। সে কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে অনেকেরই আগ্রহ কম। ভালো মেয়ে পাওয়া গেছে, কিছু টাকা পাওয়া যাবে, এই নিশ্চয়তায় বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে কি না, সে ভাবনা অনেক অভিভাবকেরই নাই।

চর কলাতলীর খালেক নগরের বাসিন্দা আবদুল ওহাব বলেন, ছেলে ও মেয়ের বয়স বেশি দেখিয়ে সব কাগজপত্র ঠিক করেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। বিয়েতে রেজিস্ট্রিও হয়। কিন্তু সেগুলো একেবারেই নামেমাত্র। বিয়ের পর এইসব কিশোর-কিশোরী দম্পতির জীবনে একের পর এক অঘটন ঘটতে থাকে। দু’একটি সন্তান জন্মের পর বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে।

এলাকার ইউপি সদস্য মো. জাফর উল্লাহ বলেন, এক সময় এই চরে ঘরে ঘরে বাল্যবিয়ে ছিল। বিয়ের সময় ছেলে ও মেয়ের বয়স প্রমাণের কাগজপত্র প্রয়োজন হওয়ায় এখন বাল্যবিয়ে অনেক কমে এসেছে। তাছাড়া অভিভাবকেরাও আগের চেয়ে সচেতন হয়েছেন।

উপকূলের প্রান্তিক জনপদে কন্যা শিশুদের পুতুল খেলার বয়সেই কখন যে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে, তা শিশু তো দূরের কথা জানে না অভিভাবকেরাও। কন্যা শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা একটা বড় সমস্যা হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ায়। উপকূলের দ্বীপ-চরে পৌঁছায় না উন্নয়নের বার্তা। বাল্যবিয়ে রোধে শহর-নগরে নানামূখী সচেতনতা বাড়ানোর কাজ হলেও এই জনপদে এসবের কোনো প্রচারণা নেই।      

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

     উপকূলে সংকটে শৈশব-১
** সাতেই হাতেখড়ি বৈঠায়


বাংলাদেশ সময়: ০২৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।