ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলে সংকটে শৈশব-৩

প্রতিকূলে শিশুশিক্ষা, বাড়ছে ঝরে পড়া

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩, ২০১৫
প্রতিকূলে শিশুশিক্ষা, বাড়ছে ঝরে পড়া ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হাজারো সংকটে উপকূলের শৈশব। এ এক অন্যরকম বেড়ে ওঠা।

এখানে শৈশব ডানা মেলে অপুষ্টি আর অশিক্ষায়। দূরন্তপনার রেশ কাটতে না কাটতেই কর্মজীবনের সূচনা। কাঁধে ভর করে ভারি কাজের বোঝা। শৈশবের রঙিন স্বপ্ন ওদের জীবনকে আলোড়িত করে না। দারিদ্র্যের বেড়াজাল নিয়ে আসে বঞ্চনার পর বঞ্চনা।

শিশু অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। পেটভর্তি খাবারের আয়োজনটা ঠিকঠাক না থাকলেও হাড়ভাঙা পরিশ্রমটা পুরো মাত্রায়। উপকূলের প্রান্তিক জনপদের শিশুদের সংকটের আদিঅন্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে বাংলানিউজ তৈরি করেছে ‘উপকূলে সংকটে শৈশব’ শীর্ষক ছয় পর্বের ধারাবাহিক। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব...

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে এসে: বেসরকারি স্কুলে পড়ার সামর্থ্য নেই। আর সরকারি স্কুলে নেই লেখাপড়ার পরিবেশ। দুশ্চিন্তায় অভিভাবকেরা। দরিদ্র্যতার সব বাধা পেরিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে দিতে চাইলেও পারছেন না অনেকেই। প্রতিকূল পরিবেশ উপকূলের শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্ন শিক্ষা গ্রহণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে প্রান্তিকের শিশুরা অবহেলা-নিষ্পেষণের বৃত্ত ভেঙে বাইরে আসতে পারছে না। এগোতে পারছে না সামনের দিকে।

উপকূলের প্রত্যন্ত জনপদ কক্সবাজারের মহেশখালীর ধলঘাটায় সমুদ্র পাড়ে পরিত্যক্ত ভবনে চলছে একটি প্রাইমারি স্কুল। বিদ্যালয়টির নাম শরইতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নড়বড়ে ভবনের দোতলায় চলছে ক্লাস। নিচে টিনের বেড়া দিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের রান্নাবান্না চলছে। শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার পানি কিংবা পয়ঃনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিছুদিন আগে আরেকটি পরিত্যক্ত ভবন থেকে এটি এখানে স্থানান্তর করা হয়েছে।

বর্ষায় স্কুলের আশাপাশের গোটা এলাকা পানিতে ডুবে গেলে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না। তখন স্কুল বন্ধ রাখা হয়। এ অবস্থায় এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আসা যাওয়া নিরাপদ নয়। এই বিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপকালে উল্টো তারাই প্রশ্ন তোলেন, আমরা তো চাই ছেলেমেয়েদের পড়াতে। কিন্তু পারছি কোথায়?      

শরইতলা স্কুল থেকে খানিক দূরে একই ইউনিয়নের সুতরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে ছাত্রছাত্রী ৩৫৭ জন, আর শিক্ষক মাত্র একজন। পাঠদানে এই শিক্ষককে সহায়তা করছেন আলিম আর বিএ পড়‍ুয়া এলাকার দুই ছাত্রী। এর বাইরে স্কুলের ঘণ্টা বাজানোর জন্য রয়েছেন একজন কর্মী।

এ অবস্থায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় অভিভাবকেরা। যোগাযোগ সমস্যা আর আর্থিক সংকটে সন্তানকে শহর এলাকার স্কুলেও পাঠাতে পারছেন না তারা। সরকারি বিদ্যালয়ের সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তাদের। তবে সবার আগে শিক্ষক স্বল্পতা দূর করার দাবিটাই তাদের কাছে প্রধান।    

সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে চোখে পড়ে সেখানকার চরম দুরবস্থার চিত্র। একমাত্র শিক্ষক, অভিভাবক, বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, সাবেক প্রধান শিক্ষকসহ এলাকার অনেকের কাছ থেকে নানান তথ্য মেলে।

বিদ্যালয় সূত্র বলছে, ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৩৫৭জন। এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ৬৪, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১০১ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৭৮জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৬৪জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৫২ জন। ২০১০ সালের জুলাইয়ে যোগদানকারী সহকারী শিক্ষক আশরাফুল আলম এই বিদ্যালয়টি পরিচালনা করছেন। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিরিন আকতার মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন।

বিদ্যালয় পরিচালনা করতে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারি শিক্ষক আশরাফুল আলম বলেন, একজনের পক্ষে এতগুলো ছাত্রছাত্রী সামলানো অত্যন্ত কঠিন। এক ক্লাসে পড়া দিয়ে আরেক ক্লাসে যেতে হয়। সকালের দিকে ক্লাসের কাজ শেষ করে আবার বিকালে স্কুলের দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করতে হয়। কখনো কখনো রাতেও কাজ করতে হচ্ছে।

শিক্ষক স্বল্পতায় শিক্ষার মানের ওপর প্রভাব পড়ছে বলে দাবি ওই শিক্ষকের। তিনি বলেন, সমাপনী পরিক্ষায় ২০১৩ সালে এ প্লাস পেয়েছিল ২ জন, এ বা এর ওপরের অবস্থানে ছিল অন্তত ১০ জন। কিন্তু ২০১৪ সালের সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ৪.৫০ এর ওপরে উঠতে পেরেছে মাত্র দু’জন শিক্ষার্থী। এ প্লাস পায়নি কেউ।

স্কুলের দেড় কিলোমিটার দূর থেকে স্কুলে আসে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সিদরাতুল মুনতাহা সাথী। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রোণতে উঠতে তার পরীক্ষার ফলাফল আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। এই ছাত্রীর মা শামীমা নাসরিন বলেন, স্কুলে শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। লেখাপড়া ভালো হচ্ছে না। প্রাইভেট পড়ানোর মত শিক্ষকও এলাকায় পাওয়া যায় না।

অবিলম্বে শিক্ষক সংকট নিরসনের দাবি তার।

বিদ্যালয় সূত্র জানায়, শিক্ষক স্বল্পতা ছাড়াও অবকাঠামোগত ও জমি নিয়ে স্কুলের কিছু সমস্যা রয়েছে। যাতে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। বিদ্যালয়ের সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুল ভবনটি সৌদি সরকারের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। এই ভবনে ৮টি কক্ষ রয়েছে। এরমধ্যে ৫টি শ্রেণিকক্ষ, বাকি ৩টির মধ্যে একটিতে অফিস, একটিতে স্টোর এবং আরেকটি ব্যবহার করছে রেডক্রিসেন্ট।

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-২ এর অধীনে বিদ্যালয়ের একটি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। দু’টি কক্ষ বিশিষ্ট এই ভবন ব্যবহার করছে ইউনিয়ন পরিষদ। অন্যদিকে স্কুল ভবনের সামনে রয়েছে একটি পরিত্যক্ত ভবন। ১৯৭৭ সালে নির্মিত এই ভবন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে। যে কোনো সময় এটি ধসে পড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

বিদ্যালয়ের একটিমাত্র নলকূপ দীর্ঘদিন ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাশের মসজিদ থেকে পানি আনতে হয়। বিদ্যালয়ের টয়লেটগুলো ব্যবহারেও রয়েছে নানান সমস্যা। ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেট নেই। রয়েছে অবকাঠামোগত আরও অনেক সমস্যা।

বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. ইউসুফ হারুন বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষক সংকট এ বিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা। এরফলে শিক্ষার্থীদের ঠিকভাবে পাঠদান করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা অনেক চেষ্টা করি, রেজ্যুলেশন করি, তদবির করি। কোনোভাবেই শিক্ষক সংকট লাঘব হয় না। শিক্ষক দেওয়ার কথা বলা হলেও দেওয়া হয় না। এ কারণে অনেক অভিভাবক মনে করছেন ছেলেমেয়েদের অন্য স্কুলে পাঠানো ভালো।

মহেশখালী উপজেলা শিক্ষা অফিসার আশীষ চিরান বলেন, ধলঘাটা এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতার বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। কর্তৃপক্ষ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।  

কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের একটি বিদ্যালয় জালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের ৬টি পদ থাকলেও শিক্ষক আছেন তিনজন। এরমধ্যে একজন বদলি হয়ে যাওয়ার পথে। আরেকজন নতুন এসেছেন। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে এলাকা থেকে একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক নেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ের ৩১৭ শিক্ষার্থীর লেখাপড়া চলছে এভাবেই জোড়াতালি দিয়ে।

এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আল-আমীন বলেন, শহরের ছেলেমেয়েদের পেছনে অভিভাবকেরা যে পরিমাণ সময় দেন, এখানে সেটা নেই বললেই চলে। ওরা বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলে যাচ্ছে ‍কি না তা তো দেখার কেউ নেই। দূরের শিক্ষকেরা এখানে এসে বেশিদিন অবস্থান করেন না এটা ঠিক, তবে অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার উন্নয়নে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

এতো গেল দ্বীপের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা। কোনোভাবে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুলে শাহপরীর দ্বীপের ছেলেমেয়েরা আরেক সমস্যায় পড়ে। তাদের অনেকের পক্ষেই মাধ্যমিক স্কুলে পড়া সম্ভব হয় না। এ দ্বীপে একটি মাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অনেকেই সে স্কুলে যেতে পারে না। ফলে প্রাথমিক স্তরেই অনেক শিশু লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হয়।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

** পুতুল খেলার বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে
     উপকূলে সংকটে শৈশব-১
** সাতেই হাতেখড়ি বৈঠায়


বাংলাদেশ সময়: ০৬২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।