সাতক্ষীরা: ‘চার-পাঁচ বার বাঁধ ভেঙে আমরা সব ভাইসে পুড়ে গেছি। বাচ্চা-গাচ্চা নিয়ে খুবই দুরাবস্থা।
এভাবেই নিজেদের দুরাবস্থার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুরের বয়োজ্যৈষ্ঠ দেবেন্দ্রনাথ মন্ডল।
তিনি বলেন, ‘আইলার পর ৬ বছর চলে গেলেও এখনো চারপাশে কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীবেষ্টিত পদ্মপুকুরের মানুষকে বাঁচাতে কোনো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। রাতে প্লাবন আতঙ্কে ঘুমাতে পারি নে। ’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলামও জানালেন হতাশার কথা।
তিনি জানান, পদ্মপুকুর ও পাশের প্রতাপনগর ইউনিয়নের কিছু অংশ নিয়ে ৭/১নম্বর ফোল্ডারে ৩৪ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১২ কিলোমিটার বাঁধ জরাজীর্ণ। ইউনিয়নের কামালকাটি, ঝাপা, পাতাখালী, বন্যতলা ও খুটিকাটি গ্রামে বাঁধের যে অবস্থা তাতে যেকোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গোটা ইউনিয়ন প্লাবিত হবে।
তিনি বলেন, অবকাঠামোগত যত উন্নয়নই হোক না কেন প্রতিবছরই বাঁধ ভেঙে সব ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ইউনিয়নে ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করে। অথচ সাইক্লোন সেল্টার আছে মাত্র ৬টি। নতুন করে দুটি নির্মাণাধীন থাকলেও জলোচ্ছ্বাস হলে মানুষ বাঁধেও ঠাঁই পাবে না।
সরজমিনে পদ্মপুকুরের কামালকাটি, ঝাপা, পাতাখালী, বন্যতলা ও খুটিকাটি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বাঁধের অবস্থা এতই জরাজীর্ণ যে ভাঙতে ভাঙতে আর বাকি রয়েছে মাত্র এক ফুট। তার উপর দিয়ে হেঁটেও চলাচল করা দুষ্কর। ভেঙে পড়েছে আশপাশের গাছপালা। অনেকেই সরিয়ে নিয়েছেন বাড়ি-ঘর।
স্থানীয় শিক্ষক শহীদ হোসেন বলেন, ২০০৯ সালে আইলার পর থেকে অদ্যাবধি পানি উন্নয়ন বোর্ড এখানে স্থায়ী কোনো বাঁধ নির্মাণ করেনি। বাঁধ ভাঙলেই যেনতেন ভাবে মেরামত করা হয়। পরে আর তাদের কোনো খোঁজ থাকে না।
কামালকাটি গ্রামের উত্তম কুমার ঘোষ জানান, এলাকাবাসী ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্ণপাত করছে না। বাঁধ না ভাঙলে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করলে মানুষ প্লাবনে ভেসে যাবে।
ঝাপার অঞ্জলি রানী জানান, ভাঙন আতঙ্কে প্রতিনিয়ত ছেলে-মেয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় তাদের। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করায় আইলায় পর প্রায় দুই বছর ধরে পদ্মপুকুরে জোয়ার-ভাটা খেলে। এতে তাদের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। পরে সাময়িকভাবে সংস্কার করা হলেও বর্তমানে যে অবস্থা তাতে বাঁধ ভেঙে আবারও প্লাবিত হতে পারে গোটা ইউনিয়ন।
স্কুল শিক্ষার্থী বাবু জানায়, বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় প্রতিবছরই তাদের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এতে পিছিয়ে পড়ছে তারা। সে বলে, ‘আমরা আর ডুবতে চাইনে। ’
স্থানীয় ইউপি সদস্য জিএম আবুল কাশেম বলেন, এখানে উৎপাদিত চিংড়ি রপ্তানি করে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। কিন্তু এখানকার মানুষের নিরাপত্তার জন্য সরকার কোনো স্থায়ী পদক্ষেপ আজও নেয়নি। স্থায়ী বাঁধ হলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হবে।
বন্যতলার আশরাফ হোসেন জানান, বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়বে। এলাকায় ৩/৪ কিলোমিটার দূরে দূরে মাত্র ৬টি সাইক্লোন সেল্টার রয়েছে। তাতে হাজার খানেক মানুষ ধরতে পারে। বাকী মানুষ দাঁড়ানোরও জায়গা পাবে না। সবই ভেসে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ বাংলানিউজকে বলেন, জেলার বিস্তীর্ণ উপকূলীয় বাধের জরাজীর্ণ অবস্থা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতে কাজ করা হবে।
জেলার উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান বাংলানিউজকে বলেন, বাধগুলো ষাটের দশকের। তারপর আর নতুন করে নির্মাণ না করায় সবগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও দ্রুত বাধগুলো সংস্কারের নির্দেশনা দিয়েছি।
পদ্মপুকুরে নতুন করে দুটি সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে আরো সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হবে।
২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাস আইলায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তারপর ৬ বছর পার হলেও সেখানে কোনো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। এতে স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৫
এসএইচ/এসআর