দুর্যোগ-দুর্বিপাকে উপকূলে বিপন্নতা বাড়ে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়িঘর।
উপকূলের বিপন্ন জনপদ ঘুরে: জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে বাড়িঘর। সব হারানো মানুষগুলো ছুঁটছে এখানে সেখানে। এর অন্যতম কারণ উপকূল সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। গত দু’বছর জোয়ারের প্লাবনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ২০১৩ সালে ২৭-২৮ জুলাই সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাসের ৩ নং সতর্ক সংকেত ছিল। সে সঙ্গে পূর্ণিমার কারণে জোয়ারের পানি ২-৩ ফুট বেড়ে যায়। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল টানা দু’দিনের বৃষ্টি। একই চিত্র লক্ষ্য করা যায় ২০১৪ সালেও। এই দু’বছরে উপকূলের জেলা কক্সবাজার ও ভোলা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ে।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার আজম কলোনি, মিয়ার ঘোনা, সতর উদ্দিন, পেয়ারাকাটা, ফয়জনির বাপের পাড়া, আকবর বলি ঘাট, চর ধুরং, বায়ু বিদ্যুৎ এলাকা, তাবলরচর প্রভৃতি এলাকায় বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে ৬টি ইউনিয়নের ৩০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
কুতুবদিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৭১ নম্বর পোল্ডারের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ৯টি স্লুইস গেটের মধ্যে অধিকাংশ গেটের দরজা নষ্ট থাকায় পানি নিষ্কাশনে মারাত্মক অসুবিধা হয়ে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।
মহেশখালী উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডেও ধলঘাট-মাতারবাড়ি এলাকার ৭০ নম্বর পোল্ডারের ২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ৪ কিলোমিটার ভেঙে গেছে। সরইতলা থেকে বনজামির ঘোনা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে মুহুরীঘোনা, পানির ছড়া, সিকদার পাড়া, সুতরিয়া, সরইতলা, বনজামির ঘোনা, বেগুনবনিয়া, পন্ডিতের ডেইল প্রভৃতি গ্রাম ব্যাপকভাবে প্লাবিত হচ্ছে প্রতিবছর।
টেকনাফ উপজেলায় সমুদ্রতীরবর্তী এলাকার ৬৮ নম্বর পোল্ডারের ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়া অংশে ৩ কিলোমিটার সমুদ্রে বিলীন হয়ে ১৬টি গ্রাম ব্যাপকভাবে প্লাবিত হচ্ছে নাফনদী তীরবর্তী এলাকার ৬৭ নম্বর পোল্ডারের অংশের বেড়িবাঁধ ভেঙে হ্নীলা ইউনিয়নের ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়া পেকুয়া উপজেলার মঘনামা ঘাট, মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুর, সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডী ও গোমাতলী প্রভৃতি এলাকায় বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকেছে। এসব ভাঙন এবং ভাঙা অংশ দিয়ে লবণপানি ঢুকে মানুষের ঘরবাড়ি, আউশ ফসল, বীজতলা, চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ, পুকুর ও মাছ, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ক্ষয়ক্ষতি হয়।
কক্সবাজার জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৪৬ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ৬৮ নম্বর পোল্ডারে ২ কিলোমিটার, কুতুবদিয়ার ৭১ নম্বর পোল্ডারে সাড়ে ৫ কিলোমিটার, পেকুয়ার মগনামা ঘাটে ১ কিলোমিটার, চৌফলদণ্ডী ও খুরুস্কুলে ৬৬/৩ নম্বর পোল্ডারে ২৫ কিলোমিটার, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী ৬৬/৪ নম্বর পোল্ডারে ১২ কিলোমিটার। সিসি ব্লক দিয়ে এ সব বাঁধের সংস্থার ও পুনর্নির্মাণে আনুমানিক ব্যয় হবে ৫৫৯ কোটি টাকা।
বেড়িবাঁধ না থাকায় গত দু’বছরে ভোলা জেলায় ক্ষয়ক্ষয়তির মাত্রা ছিল ব্যাপক। ২০১৪ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে জুলাইয়ের শেষভাগ পর্যন্ত সৃষ্ট অস্বাভাবিক জোয়ারের প্রভাবে জেলার ৬টি উপজেলার ৩০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছিল। মূলত পূর্ণিমা ও অমাবস্যার প্রভাবে এমনিতেই স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে বেশিমাত্রায় নদীর পানির উচ্চতা বাড়ে। এর উপর জুলাইয়ের শেষভাগে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ৪.৫৪ মিটার।
অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া পানির চাপে বোরহানউদ্দিন উপজেলার পক্ষীয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড থেকে শুরু করে দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত মেঘনা নদীসংলগ্ন প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ নদীতে বিলিন হয়ে যায় এবং বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ভোলা চরফ্যাশন মহাসড়কের পাশ্ববর্তী এলাকা পর্যন্ত প্লাবিত হয়েছে জোয়ারের পানিতে। বোরহানউদ্দিনের পলিটেকনিকের নিকট মহাসড়কের উপর হাঁটু পানি দেখা গেছে। ভোলা মূলভূখন্ডের বাইরে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে মনপুরা উপজেলার ৪ ইউনিয়নের ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
ভোলা জেলায় জরুরি ভিত্তিতে ৩৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পূনর্নির্মাণ না করলে চলতি বর্ষায় আবারও ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, ভোলা সদরের পূর্ব ইলিশা থেকে গাজীপুর বাজার পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার, দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিনের সৈয়দপুর থেকে পক্ষীয়া পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার, তজুমুদ্দিনের হাজীকান্দি থেকে কেয়ামুল্ল্যা পর্যন্ত ২ কিলোমিটার, মনপুরার রামনেওয়াজ থেকে মাস্টার হাট পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার, চরফ্যাশনের বাংলাবাজার (মুজিবনগর) থেকে বোয়ালী পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এবং চরফাশনের ঢালচরে চারিদিকে ১০ কিলোমিটার। সংশ্লিষ্টদের হিসেবে এতে আনুমানিক ব্যয় হতে পারে প্রায় ৬৩৭ কোটি টাকা।
সূত্র বলছে, ৬০ ও ৭০ দশকে সিসিব্লক ফেলে উপকূলীয় ভাঙন রোধে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও বিগত ৩০ বছরে বড় পরিসরে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। সম্প্রতি বাস্তবায়িত অধিকাংশ প্রকল্প আকারে ছোট এবং অস্থায়ী সমাধান। শক্ত বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় গত ৫০ বছরে ভোলা এবং কুতুবদিয়া দ্বীপ প্রায় অর্ধেক ভূখণ্ডি হারিয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণা সূত্র দাবি করেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরে উপকূলের এই দুটি দ্বীপ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা গবেষকদের।
ভোলা এবং কক্সবাজার জেলায় কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ বলছে, আর্থিক সংগতির ঘাটতি স্থায়ী কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। এখানে প্রয়োজন সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাঙন রোধে কাজ করার দৃঢ়তা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, পানি বিশেষজ্ঞ এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কাজে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মতে, ভোলা জেলার জন্য সিসিব্লক ও কক্সবাজার জেলার জন্য সীডাইক পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণ ভাঙন রোধে কার্যকর ও স্থায়ী পদ্ধতি।
তারা মনে করেন, স্থায়ী পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণ করতে ভোলার জন্য ৬০০০ কোটি টাকা এবং কক্সবাজারে জন্য জন্য ৬৫০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।
ঝুঁকিতে থাকা দুই জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, উপকূলের মানুষের সুরক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণে যে পরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন তা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে যতটা সম্ভব বাঁধ নির্মাণ ও পূননির্মাণের কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৩৫৫ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৫
আরআইএম/জেডএস
উপকূল থেকে উপকূল
অরক্ষিত উপকূল-৩
ডুবছে বাড়িঘর, হারাচ্ছে ফসলি জমি
রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।