ঢাকা, বুধবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

অরক্ষিত উপকূল-শেষ পর্ব

শক্ত উঁচু বাঁধের দাবি উপকূলবাসীর

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৬ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৫
শক্ত উঁচু বাঁধের দাবি উপকূলবাসীর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দুর্যোগ-দুর্বিপাকে উপকূলে বিপন্নতা বাড়ে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়িঘর।

আশ্রয়হীনেরা ছুটে চলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। বাপ-দাদার পুরনো ভিটে ছেড়ে দিয়ে মাথা গোঁজে বাঁধের ধারে। কারও ঠিকানা মেলে শহরের রাস্তার ধারে। কখনো জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, কখনো বা অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়া।

বর্ষায় ভাঙণের চিত্রটা এখন একেবারেই স্বাভাবিক। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপকূলে বাড়ছে এই দুর্যোগের ঝুঁকি। দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলবাসীর দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। ঝুঁকি বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। তবু উপকূল থেকে যায় অরক্ষিত। এসব নিয়ে অরক্ষিত উপকূল শিরোনামে বাংলানিউজের আট পর্ব ধারাবাহিকের আজ পড়ুন শেষ পর্ব

উপকূলের বিপন্ন জনপদ ঘুরে: সমুদ্রের পানি বাঁধ উপচে বাড়ি-ঘরে ঢোকে। তাই বাঁধের ওপরে সারিবদ্ধ ব্লক ফেলেছেন সমুদ্রপাড়ের বাসিন্দারা। আবার কোথাও বিধ্বস্ত বাঁধের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে আসা পানি ঠেকাতে ফেলা হয়েছে বালুর বস্তা। যেখানে কোনো বাঁধ নেই, সেখানকার মানুষ সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকে। বর্ষার কয়েকটি মাস তাদের জীবন বদলে যায় একেবারেই।

বঙ্গোপসাগরে জেগে থাকা দ্বীপ কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার সমুদ্র তীর ধরে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে এই চিত্র দেখতে পায় বাংলানিউজ।

কুতুবদিয়ার দক্ষিণ প্রান্ত তাবালর চর, কিরণপাড়া, হায়দারপাড়া, বড়ঘোপ, ধুরুংসহ বাঁধের পাড়ের বিপন্ন বসতিতে বসবাস করছেন হাজারো মানুষ। শুকনো মৌসুমে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও বর্ষায় এদের জীবন থাকে হাতের মুঠোয়।

ঘরে শুয়ে এখানকার মানুষ সমুদ্রের ঢেউ দেখে। সূর্যাস্তের লোভনীয় সময়টা উপভোগ করতে পারে ঘরে বসেই। ইচ্ছে হলে সমুদ্র সৈকতে বালুকাবেলায় খানিকটা সময় কাটিয়েও আসতে পারেন। কিন্তু সে সময় এখানকার মানুষদের নেই। সমুদ্রের সঙ্গে যেন এরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই বেঁচে আছেন। বর্ষা মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে এদের ভয় বাড়তে শুরু করেছে। সমুদ্র উত্তাল হতে শুরু করেছে, কিন্তু নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই।

কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের হায়দার পাড়ায় সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় রহমত উল্লাহ জানাচ্ছিলেন দুর্যোগের দিনের আতঙ্কের কথা। এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য সমুদ্রপাড়ের এ বাসিন্দা জানালেন, বাঁধ থাকলেও এ বাঁধ উপচে পানি ঢোকে বাড়ি-ঘরে। বাঁধের উপর দিয়ে পানি আসে বলে সারিবদ্ধভাবে কিছু ব্লক ফেলে রাখা হয়েছে। এতে ঢেউয়ের ঝাপটা কিছুটা কমে।

খানিক দূরে কিরণপাড়া। এখানে বাঁধের একটি অংশ বিধ্বস্ত হলে এক বছর আগে মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু যতোটা উঁচু করে বাঁধ করার প্রয়োজন ছিলো, ততোটা হয়নি। ফলে বিধ্বস্ত এ অংশের উপর দিয়েই পানি উপচে বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ে। গত বর্ষায় স্থানীয় উদ্যোগে বালুর বস্তা ফেলে বাঁধ মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু এবারের বর্ষায় কী হবে এলাকাবাসী জানেন না।

কিরণপাড়ার বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানালেন, বিধ্বস্ত এ বাঁধের পাশে রয়েছে অসংখ্য বাড়ি-ঘর। বেশকিছু চিংড়ি ঘের ও ফসলি জমিও রয়েছে। কোনোভাবে বাঁধ ভেঙে গেলে ব্যাপক ক্ষতি হবে। শুনেছি, বাঁধ মেরামত করা হবে। কিন্তু এখনও তো কাজ শুরুই হলো না। বর্ষা তো এসে গেল।

তাবালর চর এলাকায় সমুদ্রের তীরে প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিহীন অবস্থায় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সমুদ্রের বাঁকের কারণে পানির প্রবল চাপ থাকায় বার বার বাঁধ দেওয়া হলেও তা ভেঙে যায়। বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে এখানে আবার নতুন বাঁধ হচ্ছে। কিন্তু কাজের মান নিয়ে এলাকাবাসী প্রশ্ন তুললেন। তারা অভিযোগ করেন, যেভাবে বাঁধে বালু ফেলা হচ্ছে, তাতে বর্ষা পর্যন্ত এ বাঁধ টেকসই হয় কি না সন্দেহ।

তাবালর চরের কুতুব বাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, এ এলাকার সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ আছে বলে আমাদের চোখে পড়ে না। একই সমস্যা দেখে আসছি যুগ যুগ ধরে। বাঁধ তৈরির জন্য যে টাকা ব্যয় হচ্ছে, সেটার যথাযথ ব্যবহার হলেও অন্তত কিছুটা রক্ষা হতো।        

কিরণ পাড়া কিংবা হায়দার পাড়ার মানুষেরা এখন যেভাবে ভাঙন রোধ, জলোচ্ছ্বাস রোধ আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তুলছেন; কুদিয়ার টেক এলাকার মানুষও একই দাবি তুলে আসছিলেন যুগ যুগ ধরে। কিন্তু সে দাবির প্রতি কারও কর্ণপাত নেই। শেষ রক্ষা হয়নি কুদিয়ার টেকের তিন সহস্রাধিক মানুষের। ওই এলাকার পাশেই তাবালন চর এলাকাটিও এখন বিপন্ন। হয়তো কুদিয়ার টেকের পথ ধরতে হবে তাবালর চরসহ কুতুবদিয়ার আরও অনেক এলাকার। তারপরও কুতুবদিয়ার বিপন্ন মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কি না, জানেন না এলাকাবাসী।      

একটা উঁচু আর শক্ত বাঁধের দাবি এলাকার মানুষের। তাহলেই কেবল সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁধের তীরের মানুষদের বাঁচানো সম্ভব।  

উপকূলের বিপন্ন মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি উঁচু ও শক্ত বাঁধ। প্রতিনিয়ত চরম আতঙ্কে থাকা মানুষেরা বেঁচে থাকার তাগিদেই এ দাবি জানিয়ে আসছেন। অতি সম্প্রতি উপকূলীয় বাঁধ তিন ফুট উঁচু করতে বিশেষ প্রকল্প নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ খবরে উপকূলের বিপন্ন মানুষেরা সন্তষ্ট। দীর্ঘদিনের দাবির বাস্তবায়নে বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন দেখছেন তারা। তবে এ বাঁধ শক্ত করে নির্মাণের জোরালো দাবি তাদের।

সূত্র জানায়, উপকূলীয় বাঁধের এ অবস্থা বিবেচনায় রেখে বেড়িবাঁধ তিনফুট উঁচু করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পে ৩ হাজার ২শ’ ৮০ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব বিবেচনায় রেখে বাঁধ উঁচু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে এর সঠিক বাস্তবায়ন চান উপকূলবাসী।   

তথ্যসূত্র অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে দেশের উপকূল এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বর্ষাকালে মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর। অনেকেই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। পেশায় পরিবর্তন আসায় জীবন-জীবিকায় পড়ছে মারাত্মক প্রভাব।  

উপকূলের বেড়িবাঁধের নানামুখী সমস্যা নিয়ে বাংলানিউজে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বেড়িবাঁধের দুর্বলতার কারণেই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রবল চাপের মুখে পড়েন উপকূলীয় এলাকার মানুষ। নাজুক বাঁধ ভেঙে প্রতিবছর উপকূলে হাজারো মানুষের ঘর-বাড়ি ভেসে যায়। মানুষগুলো তখন পথে বসে। অথচ এ বাঁধ পুনঃনির্মাণে, বাঁধ উঁচু করতে কিংবা প্রশস্ততা বাড়াতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়।  
 
বাগেরহাটের শরণখোলার সিডর বিধ্বস্ত সাউথখালী গ্রাম সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, যেখানে সিডর বড় ধাক্কাটা দিয়েছিল, কিংবা অন্যান্য দুর্যোগে যে জায়গাটি দিয়ে পানি উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়তো, সেই জায়গাটি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। জোয়ারের পানি বাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে। এ বাঁধ কোথাও ছয় ফুট, কোথাও আট ফুট আবার কোথাও দশ ফুট। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অন্তত কুড়ি ফুট উঁচু বাঁধের দাবি এলাকাবাসীর। প্রতিটি ঝড়ের পর একই দাবি উঠলেও সে দাবি কাগজেই থেকে যায়।

একই উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের তাফালবাড়ি বাজারের ছোট্ট চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিলো ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহজাহান বাদল জোমাদ্দার, স্থানীয় বাসিন্দা জামাল হোসেন জোমাদ্দার, মিন্টু মিয়াসহ আরও অনেকের সঙ্গে। সিডরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তারা জানান, ওই দুর্যোগে অন্তত ১৫ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছিলো। কিন্তু বাঁধ আছে মাত্র ১০ ফুট উঁচু। সিডরের পর বাঁধের বিভিন্ন এলাকায় কাজ হলেও তাতে উচ্চতা সর্বোচ্চ তিন ফুট বাড়তে পারে।

সূত্র জানায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বেড়িবাঁধ উঁচুকরণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেশের ছয়টি উপকূলীয় জেলার ১৬টি পোল্ডারে কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। আগামী মার্চ মাস নাগাদ এসব এলাকায় কাজ শুরু হবে। প্রকল্পের আওতায় বেড়িবাঁধ তিন ফুট করা হবে এবং বাঁধ সংশ্লিষ্ট স্লুইজ গেটগুলো পুনঃনির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে ১৯ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দেয় সরকার। বিশ্বব্যাংক প্রাথমিকভাবে তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

বাঁধ উঁচুকরণের সরকারি এ উদ্যোগে সন্তোষ প্রকাশ করে উপকূলের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলেছেন, বাঁধ উঁচু করার দাবি দীর্ঘদিনের। শুধু বাঁধ উঁচু করলে হবে না। শক্ত করে বাঁধ তৈরি করতে হবে। ব্লক ফেলে বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে হবে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্টট্রাস্ট’র নেতৃত্বাধীন উপকূল সুরক্ষায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর জোট নেতারা বলেছেন, স্থায়ী সমাধানে রাজনৈতিক নেতাদের স্বউদ্যোগী মনোভাব বেশি প্রয়োজন। দ্বীপ জেলা ভোলাকে স্থায়ীভাবে রক্ষা করতে হলে ৬ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। সেখানে নদীর তলদেশ থেকে তীরের উচ্চতা পর্যন্ত ব্লক স্থাপন করে নদীর তীর রক্ষা করতে হবে। ব্লকসহ রিং বাঁধ দিতে হবে, যাতে জোয়ারে পানি ঢুকতে না পারে। অন্যদিকে কক্সবাজারের জন্য প্রয়োজন হবে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। সেখানে সিসিব্লক এবং কোনো কোনো স্থানে সি-ডাইক পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

ওই জোট পানি উন্নয়ন বোর্ড ও টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সিস্টেম লস কমানোর দাবি তোলেন। জোটের নেতারা বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড দুর্নীতিমুক্ত হলে এবং টেন্ডরিং ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে মোট খরচের চেয়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ কম খরচে নদী রক্ষার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে। বাঁধ নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ কর্মকাণ্ডে পানি উন্নয়ন বোর্ডে পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে কাজ শেষ করতে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল ইউনিটকেও যুক্ত করার দাবি জানান তারা।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এ ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০১২৭ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৫
AviAvBGg/এএ/আরএম

** দুর্যোগের ‘ক্ষত’ বদলে দেয় জীবনের গতি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।