ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

কুয়াকাটা উপাখ্যান-৩

মহাপরিকল্পনা ফাইল চাপা, সংকট সীমাহীন

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫২ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৫
মহাপরিকল্পনা ফাইল চাপা, সংকট সীমাহীন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সমুদ্রের নোনা জলের ঝাপটায় অপরূপ সৌন্দর্য্য নিয়ে জেগে আছে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। বিকাশের ধারায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই পর্যটন কেন্দ্র।

অনেক সম্ভাবনা, অনেক স্বপ্ন। এখানকার সৈকতের দীর্ঘ বেলাভূমিতে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আকর্ষণ দেশজোড়া।

দলে দলে পর্যটকেরা ছুটে আসেন এই বেলাভূমিতে। তবুও কোথায় যেন থেকে যায় একের পর এক সংকট। জটিলতার অবসান হয়না কিছুতেই। সংকটের ভেতর দিয়েই ডানা মেলছে কুয়াকাটা। তারপরও প্রতিটি নতুন ভোরে নতুন আশাবাদ। এই বুঝি কুয়াকাটা ফিরে পেল প্রাণ। এইসব নিয়ে কুয়াকাটা উপাখ্যান শিরোনামে বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ঘুরে এসে: মহাপরিকল্পনা আটকে থাকায় সাগরকন্যা কুয়াকাটার বিকাশের পথে হাজারো বাধা। সমস্যা দেখা দিচ্ছে পদে পদে। পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। হাটবাজার, দোকানপাট যত্রতত্র। পরিকল্পনাহীন এক নগর গড়ে উঠছে এখানে। আর এটাই বিকাশমান পর্যটনে এক সময় বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে।   

পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা ঘুরে চোখে পড়ে বহুমুখী অনিয়মের চিত্র। ভূমিগ্রাসীদের খাসজমি দখল থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবাসন বাণিজ্য, সবই আছে এখানে। পর্যটনকেন্দ্রের আশপাশে ফসলি জমিতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে চলছে রমরমা আবাসন বাণিজ্য। আর এর প্রভাবে শত শত একর ফসলি জমি নিঃশেষ হতে চলেছে।

এখানে খাসজমি বণ্টনে রয়েছে অব্যবস্থাপনা। সৈকত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব তো আছেই। অথচ যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের মধ্যদিয়ে কুয়াকাটায় আরও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।  
 
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কুয়াকাটাকে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আছে দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা অনুমোদন না হওয়া। কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এখনও গঠিত হয়নি। আর এ কারণেই পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার প্রায় ১৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কুয়াকাটা সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি।   

সূত্র বলছে, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের আগে মহাপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন মহাপরিকল্পনা তৈরির লক্ষ্যে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করে। ২০১০ সালের ১৯ মে এই পরিকল্পনা তৈরির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শেলটেক কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী, গঙ্গামতি, কাউয়ার চর ও চরচাপালী এই চারটি মৌজা কুয়াকাটা পর্যটনের মহাপরিকল্পনার আওতায় আনা হয়।

‘বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ কুয়াকাটা সৈকত দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসক এই কমিটির প্রধান। কিন্তু এই কমিটির দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। রক্ষাণাবেক্ষণসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এ কমিটি বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কুয়াকাটার পর্যটন বিকাশে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে ‘কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের।

পর্যটকদের আকৃষ্ট করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সৈকত নগরীর উন্নয়ন হবে এই কর্তৃপক্ষের কাজ। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের লক্ষ্যে সরকারি প্রজ্ঞাপণে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও জেলা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়। কিন্তু উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আজও আলোর মুখ দেখেনি।     

কুয়াকাটা আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ‘কুয়াকাটা ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন’ সূত্র বলেছে, কুয়াকাটার মহাপরিকল্পনা অনুমোদন না হওয়ায় এখানে বহুমুখী সমস্যা দেখা দিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য স্থিমিত হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে।

স্থানীয়ভাবে পাওয়া সূত্রে দাবি করা হয়, কুয়াকাটায় অন্তত অর্ধশতাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার একর জমি কবলা ও বায়নাসূত্রে দখল করে রেখেছে। অপরিকল্পিতভাবে এসব জমিতে তারা গড়ে তুলছে স্থাপনা।

কলাপাড়া উপজেলা সহকারী ভূমি অফিস ও মহিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্র জানিয়েছে, কুয়াকাটার চারটি মৌজায় প্রায় ২০ হাজার একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে কৃষি খাসজমি এক হাজার ৭৫৩ একর। খাসজমির এক বিরাট অংশ আবাসন ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে।

অন্যদিকে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার পর প্রাকৃতিক বিবর্তনে নতুনভাবে জেগে ওঠা চরের মালিকানা নিয়ে স্থানীয় ভূমি অফিসের হিসাবে অস্পষ্টতা রয়েছে। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো এর সুযোগ নিচ্ছে। ফসলিসহ অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত প্রায় ১০ হাজার একর জমি আবাসনে বেদখল হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা হয় ১৯৯৮ সালের দিকে। সেই থেকেই এখানকার জমির ওপর আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর নজর পড়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখানে এসে ব্যবসা শুরু করে। সাইনবোর্ড লাগিয়ে গ্রাহকদের নজর কাড়াই ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম লক্ষ্য।

একদিকে সাইনবোর্ড লাগানো, অন্যদিকে চলে লোভনীয় বিজ্ঞাপন। এদের সঙ্গে স্থানীয় ভূমি দালালচক্র ও ভূমি অফিসের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ। পরে অবশ্য এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। কিন্তু তাতেও এদের তৎপরতা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। মাস্টারপ্ল্যান না হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে এরা।
  
ভূমিগ্রাসীদের তৎপরতা রোধ ও খাসজমি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসককে লিখিত পত্রে জানানো হয়, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকাকে বিশেষ পর্যটন অঞ্চল হিসাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে।

ওই এলাকায় ভবিষ্যতে বিমানবন্দর, সরকারি হাসপাতাল, রেস্টহাউস, হোটেল-মোটেল, পার্ক, ফায়ার ব্রিগেডসহ অন্যান্য অবকাঠামো স্থাপনের প্রয়োজন হবে। তাই ভূমিহীনদের মধ্যে জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ার কার্যক্রম বন্ধ রাখা এবং ভূয়া বন্দোবস্তগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয় চিঠিতে।

পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সৈকতের আন্ধারমানিক নদীর মোহনা লেম্বুর চর থেকে গঙ্গামতি হয়ে কাউয়ার চর পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার সৈকতজুড়ে বেড়িবাঁধের বাইরে ২২৮টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। এসব স্থাপনার ৯০ শতাংশ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো মালিকপক্ষের মামলার জটিলতায় ভাঙা সম্ভব হয়নি।

পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক অমিতাভ সরকার বলেন, ইতোমধ্যে কুয়াকাটার উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন ও টাওয়ার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় সৈকতের দু’দিকে এক কিলোমিটার এলাকায় বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মহাপরিকল্পনা অনুমোদন পেলে কুয়াকাটা উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০২৫১ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৫
আরআইএম/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।