ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের জেলে জীবন-৭

গভীর সমুদ্রে নেই জীবনরক্ষার কোনো সরঞ্জাম

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৫
গভীর সমুদ্রে নেই জীবনরক্ষার কোনো সরঞ্জাম ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের জীবিকা নির্বাহ হয় বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকার করে। বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব জেলের দুর্দশার অন্ত নেই।

একদিকে সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই, আরেক দিকে দস্যু আতঙ্ক। এছাড়া মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে রয়েছে দাদনের নিপীড়ন। সেইসঙ্গে অভাব আর টানাপড়েনে জর্জরিত উপকূলের জেলে পরিবারগুলোতে বেড়ে চলছে ঋণের বোঝা। উপকূলের জেলেদের অন্তহীন দুর্দশার চিত্র নিয়ে বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদারের আট পর্বের প্রতিবেদনের আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব।

উপকূলের জেলে পল্লী ঘুরে: ঘাটে এফবি আল্লাহর দান প্রস্তুত সমুদ্রযাত্রার জন্য। ২০ জন জেলে ও একজন মাঝি নিয়ে ট্রলারটি মহাজনের ইশারার অপেক্ষায় রয়েছে। ইশারা মাত্রই গভীর সমুদ্রে ইলিশ শিকারের উদ্দেশে যাত্রা করবেন জেলেরা।

এই ট্রলারটিতে রয়েছে নামমাত্র তিনটি লাইফ বয়া। সমুদ্রের বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে এবং প্রতিকূলতা মোকাবেলায় ট্রলারটিতে নেই আর কোনো জীবন রক্ষার সরঞ্জাম।

এভাবেই চলছে উপকূলের মাঝি-মাল্লা আর জেলেদের জীবন। জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই  গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে যাচ্ছেন জেলেরা।

এদিকে, প্রতিনিয়ত বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে ইলিশ শিকার করা জেলেদের নিরাপত্তায় নেই কার্যকরী সরকারি-বেসরকারি কোনো পদক্ষেপ।

উপকূলের জেলেদের জন্য ট্রলারগুলোতে থাকে না পর্যাপ্ত লাইফ বয়া। দেওয়া হয় না কোনো লাইফ জ্যাকেট। ফলে শতভাগ ঝুঁকির মধ্যেই নিত্যদিন মাছ শিকারে ব্যস্ত জেলেদের জীবন ঘুরপাক খায় নিশ্চিত অনিশ্চয়তায়।

জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে মাছ ইলিশ শিকারীদের একজন আউয়াল। গত ১০ বছর ধরে এফবি অল্লাহর দান ট্রলারে করে মাছ শিকার করছেন তিনি। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য কখনোই পাননি লাইফ জ্যাকেট কিংবা লাইফ বয়া।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা যার ট্রলারে যাই হেয় যদি আমাগো নিরাপত্তা না দেয় তাইলে কে দিব। হেয় তো কখনো আমাগো লাইফ বয়া ও লাইফ জ্যাকেট নিতে বলেনি। আমরা কিভাবে নিব। ’

মাছ শিকারীদের অনেকের আবার লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয়া সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এদেরই একজন সোবাহান।   জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লাইফ জ্যাকেট হেইডা আবার কি?’

অন্যদিকে, নিরাপত্তাজনিত কারণে ও বৈরী আবহাওয়ায় গত ১০ কত সংখ্যক জেলে প্রাণ হারিয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে এ সংখ্যা কয়েক সহস্রাধিক বলে মনে করেন উপকূলের জেলেরা।

এখন ওইসব জেলে পরিবারের বেশিরভাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি কেউ।
 
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৬ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর ঘূর্ণিঝড়ে ট্রলারডুবে বঙ্গোপসাগরে নিখোঁজ হয় বরগুনার দুই শতাধিক জেলে। ভয়াবহ ওই সামুদ্রিক ঝড়ে দক্ষিণ উপকূলের বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, ভোলা ও পিরোজপুরের সহস্রাধিক জেলে নিখোঁজ হন। তবে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই কারো কাছে।

সরকারি হিসাবে ওই ঝড়ে বরগুনা জেলার ৪৪ জন জেলে নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা দুই শতাধিক বলে জানিয়েছেন জেলা ট্রলার মালিক সমিতির নেতারা।

নিখোঁজ ওই জেলেরাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাকে হারিয়ে তাঁদের স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে মানবেতর দিন কাটালেও কেউ তাঁদের খোঁজ রাখে না।

সম্প্রতি বরগুনা সদরের গাজী মাহমুদ, গুলিশাখালী ও পাথরঘাটা উপজেলার মাছেরখাল গ্রামে গিয়ে ওইসব জেলে পরিবারের মানবেতর জীবন-যাপনের দৃশ্য চোখে পড়ে।

জেলেরা আরো জানান, সাম্প্রতিক সময়ে নিরাপত্তা রক্ষায় জেলেদের সচেতন করতে সরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকলেও স্থানীয় জেলে নেতা ও ব্যবসায়ীরা তাদের গভীর সমুদ্রে লাইফ জ্যাকেট ব্যবহারে উৎসাহী করে তুলছে।

এ বিষয়ে পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রিপন বাংলানিউজকে বলেন, জেলেরা সচেতন না হওয়ায় প্রতিবছর সমুদ্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারাতে হয় তাদের। তবে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য বন্দর থেকে প্রতিটি ট্রলারে পর্যাপ্ত বয়া ও জেলেদের লাইফ জ্যাকেট ব্যবহারে উৎসাহী করে তোলা হচ্ছে। জেলে ও মৎস্য বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন সময় ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে।

জেলেদের মধ্যে বিনামূল্যে লাইফ জ্যাকেট বিতরণ করা হলে তারা এগুলো ব্যবহারে তারা আরো উৎসাহী হবে বলেও তিনি মনে করেন।

জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বঙ্কিম চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, সরকার জেলেদের নিরাপত্তায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকারে যেতে হলে চট্টগ্রাম ও খুলনা মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্ট থেকে একটি সনদ সংগ্রহ করে যেতে হয়। যেখানে লাইফ বয়া ও লাইফ জ্যাকেট সম্পর্কেও জেলেদের বলা হয়ে থাকে।

তবে কেউ যদি সেগুলো না নিয়ে যায় সেটা তাদের দায়ভার। এক্ষেত্রে মৎস্য বিভাগের কিছু করার নেই বলে মন্তব্য তার।

বাংলাদেশ সময়: ০৩০৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৫
এসআর

** হেই যে গেলো আর আইলো না
** বিদেশি ট্রলার আতঙ্ক!
** গভীর সমুদ্রে মেলে না প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস
** দস্যুদের কার্ডেও নেই জীবনের নিশ্চয়তা
** দস্যু ভয় তবু যেতে হয়
** ঋণ-দাদনে দিশেহারা জীবন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।