রামপাল (বাগেরহাট) থেকে ফিরে: সুন্দরবনের কোল-ঘেষা জনপদ রামপাল। মাত্র ২৭৬ দশমিক ৪৫ বর্গ কিলোমিটার আয়োতনের ছোট এই উপজেলায় নদী খালের সংখ্যা ২০৫টিরও বেশি।
নেই সবুজের সমারোহ। মাঠে কৃষকের ফসল নেই, গোলা ভরা ধান নেই, গোয়াল ভরা গরু নেই, বরজে পান নেই, বাগানে নেই নারিকেল-সুপারিও।
মরে যাচ্ছে গাছপালা, কমে গেছে চাষের জমি। সবুজে ঘেরা সেই প্রকৃতি এখন নোনা রুক্ষতায়।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র। তবে সবুজে ঘেরা প্রকৃতির এমন বিপর্যস্ত রূপ যে এক দিনে হয়নি, তা জানা গেলো স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে।
উপজেলার বাঁশতলী ইউনিয়নের চন্ডিতলা গ্রামের শেখ ফজলে আলী (৮২) ও শেখ ইসাক আলী (৭৬) এ প্রতিবেদকে জানান, গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে প্রকৃতির এমন বিরূপ চিত্র। ৩০-৪০ বছর আগে এখানকার মানুষের জীবিকা চলতো খেত কৃষিতে। এখন লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে যেমন মাঠে ফসল উৎপাদন করা যাচ্ছে না একই সঙ্গে মারা যাচ্ছে গাছপালা। কমে যাচ্ছে নারকেল, সুপারি, পানসহ এ অঞ্চলের প্রায় সব ফলের উৎপাদন।
১৯৭৯-৮০ সাল থেকে লবণ পানি আটকে এ অঞ্চলে শুরু হওয়া চিংড়ি চাষের প্রভাবেই এখনকার এই রুক্ষ চিত্র মনে করেন স্থানীয় এই দুই প্রবীণ।
পেশায় ভ্যানচালক পাশের গ্রাম ইসলামাবাদের রোফ শেখও (৫৫) মনে করেন লবণাক্ততার কারণেই এই অঞ্চল এখন বিরান হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাঁধের কারণেই এমন দশা। বাঁধ দিয়ে নোনা পানি আটকে চিংড়ি চাষ হয় এখানে। গত প্রায় ৩৫-৩৬ বছর থেকে এভাবে লবণ পানি আটকে রাখার কারণে তৈরি হয়েছে এই অবস্থা।
চন্ডিতলা গ্রামের সত্রেন্দ্র থান মিস্ত্রির ছেলে গৌরঙ্গ মিস্ত্রি (৩৫) এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার বয়স যখন ১৮-২০ বছর তখনও এ এলাকায় কোনো নোনা ছিলো না। বছরে এক বারই আমন ধান হতো। এক বিঘা জমি থেকে ৭০-৮০ মণ ধান পেতাম। বছরে নিজেদের খারার জন্য ৩০-৩৫ মন রেখেও ৫০ মন ধান বিক্রি করতে পারতাম।
‘আমাদের একশ’র মতোন নারকেল গাছ এবং দুটি সুপারি বাগান ছিলো। নোনার কারণে একদিকে যেমন গাছ মরে গেছে, আর যা আছে তাতেও এখন কোনো ফলোন হয় না। ’
তার মতে, তখন কোনো বাঁধ ছিলোনা, নোনা পানিও এখানে আটকে থাকতো না। যে গতিতে পানি আসতো সেই গতিতে নেমে যেতো। ফলে নদী খালোও কোনো পলী জমতো না। আর নদীর পানির সঙ্গে যেটুকু নোনা আসতো বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে তা ধুয়ে নেমে যেত খাল-নদী দিয়ে।
নোনা পানি আটকে চিংড়ি চাষ বন্ধ, নদী-খাল আটকে বিভিন্ন সময় তৈরি সব বাঁধ অপসারণ এবং নদীকে নাব্য করতে খনন ও নদী তীরে প্লাবন ভূমি রক্ষা করা গেলে আবারো এ অবস্থা থেকে মুক্তি মিলতে পারে বলে মনে করেন এখনকার সাধারণ মানুষ।
খালগুলোর বর্তমান চিত্র অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার রামপাল উপজেলায় দুই শতাধিক রেকর্ডভূক্ত খালের অধিকাংশই গত ৩০ বছর ধরে ছিলো অবৈধ দখলদারদের দখলে। যার একটি বড় অংশ ভরাট হয়ে গেছে। বাকি গুলোতে বাঁধ দিয়ে আটকে মাছের চাষ করছেন প্রভাবশালীরা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে খাল থেকে অবৈধ বাঁধ উচ্ছেদ অভিযান শুরুর পর স্থানীয় প্রশাসন মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে, অনেক সরকারি খালের জমি বিভিন্ন সময়ে বেআইনিভাবে ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডভূক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের দাবি স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত তদারকির অভাবে সরকারি রেকর্ডিও খালগুলোকে দখল মুক্ত ও প্রবাহমান করা যাচ্ছে না।
বিষয়টি মাথায় নিয়ে ইউনিয়ন তহশিল অফিসের মাধ্যমে উপজেলা তহশিল অফিস এ ধরনের দখল হওয়া খালের তালিকা তৈরি করেছে।
খাল খননে প্রধানমন্ত্রীর পুনঃনির্দেশ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশে ৫ আগস্ট থেকে দখল হওয়া খালেগুলো পুনরুদ্ধারে আবারও মাঠে নামে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসন।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, দ্বিতীয় দফায় আগের তালিকাভূক্ত ২৩টি খাল ও তার বিভিন্ন শাখা, উপ-শাখা মিলে উপজেলার মোট ৮২টি খাল চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে খালগুলির সব বাঁধ অপসারণ করা হচ্ছে।
কোস্টাল ডেভলপমেন্ট পার্টনারশিপের (সিডিপি) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী ইকবাল হোসের বিপ্লব জানান, অপরিকল্পিত বাঁধের কারণে গত কয়েক দশকে ধীরেধীরে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যে চিংড়ি চাষের জন্য বাঁধ দিয়ে নোনাপানি আটকে রেখে আজ বিপর্যের সৃষ্টি হয়েছে, অতিরিক্ত লবণাক্ততায় চিংড়ির উৎপাদনও কমে গেছে।
রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিব কুমার রায় জানায়, উপজেলার অধিকাংশ খালে দেওয়া অবৈধ বাঁধ এরই মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব খালে যেন আর কেউ বাঁধ দিতে না পারে সে ব্যাপারে নজর রাখছে উপজেলা প্রশাসন।
বাঁধ অপসারণ কাজে ভ্রাম্যমাণ আদলত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্টেট মাফ্ফারা তাসনিয়া ও আলী সিদ্দিকী জানান, খাল গুলোকে প্রবাহমান করাতে বাঁধ অপসারণ কাজে স্থানীয় জনগণের সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় বরাদ্দেরও অভাব রয়েছে।
রামপাল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল জলিল বলেন, চ্যানেল চালুর জন্য সরকার যে ভাবে এগুচ্ছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। আরো বেশি সুপরিপল্পিত এবং সমন্বিত ভাবে অগ্রসর না হলে সরকারে এই উদ্যোগ ভেস্তে যাবে।
এরআগে কাবিখার খাল পূণঃউদ্ধারের কাজও ভেস্তে গেছে। যার প্রবাহমান খালে অবৈধ ভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে প্রশাসন জনগণের অর্থ ব্যয় করে বাঁধ অপসারণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এটি মোটেও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।
তিনি আরো বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের উচিৎ ছিলো অর্থের অপচয় না করে যারা বাঁধ দিয়েছে তাদের দ্বারা সরকারি খালের বাঁধ অপসারণ করানো। প্রয়োজনে তাদের সাজার ব্যবস্থা নিলে এই প্রবণতা বন্ধ করা যেত।
ঘষিয়াখালী চ্যানেল চালু এবং চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষায় বাঁধ অপসারণ, প্লাবন ভূমি তৈরির এই কার্যক্রম সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনে সেনা বাহিনীর সহায়তার নেওয়ার পরামর্শ তার।
বিআইডব্লিউটিএ’র তত্ত্বাবধায়ক (ড্রেজিং) প্রকৌশলী এ এইচ ফরহাদুজ্জামান জানান, বর্তমানে পূর্ণ জোয়ারে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যনেল দিয়ে ১১ ফুট গভীরতা সম্পন্ন জাহাজ চলাচল করতে পারছে। খনন কাজ অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পলি জমায় খনন কাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে। চ্যানেল সংশ্লিষ্ট খালগুলো অবৈধ বাঁধ অপসারণ ও খনন করা হলে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে পানির প্রবাহ বেড়ে যাবে। যা চ্যালেনটি নাব্য করতে এবং পলি অপসারণে সহায়ক হবে।
বাগেরহাটে পানি উন্নয় বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান বাংলানিউজকে জানান, দখলের ফলে ভরাট হয়ে যাওয়া নদী খাল পুনরুদ্ধারে তারা একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর আলম জানান, বাঁধ অপসারণ এবং সরকারি রেকর্ডভূক্ত এসব খালের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন অভিযান শুরু করেছে। এখন পর্যান্ত জেলা প্রশাসনের তালিকাভূক্ত ৮৩টি খালের মধ্যে ৩০টি খালের ১০৫টি ও দু’টি পাটা বাঁধ অপসারণ কর হয়েছে।
বাঁধ অপসারণের পর আগামী শুকনো মৌসুমে রামপালের ৮৩টি সরকারি রেকর্ডীয় খাল খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ জন্য একটি প্রকল্পও চূড়ান্ত করতে কাজ চলছে। এই কাজ শেষ হলে আবারও সাভাবিক পরিবেশ ফিরে পাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৫
এসএইচ