উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: কই জামু, কি খামু, কইতে পারি না, এহন বাহি আছে শুধু মরা। হক্কলে মরছে মুই ক্যা মরলাম না তাইলে তো এহন আর এই কষ্ট করা লাগতে না।
এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বললেন বরগুনা সদর উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের ময়না বেগম।
ঘূর্ণিঝড় সিডরে মা, বাবা, ভাই, বোন ও স্বামীসহ একসঙ্গে হারিয়েছেন পরিবারের ১৩ জনকে। ভাগ্যক্রমে সেই সময় ঢাকায় থাকায় বেঁচে যান তার দুই ভাই ও তিনি। তবে ভাগ্য দেবতা এখানেও রুষ্ট হলেন তার প্রতি, সিডরের দুই বছর পর আকস্মিক এক ঝড়ে হারিয়েছেন অবশিষ্ট দুই ভাইকে। তাদের খোঁজ মেলেনি এখনো।
সব হারিয়ে ময়না এখনো টিকে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে এ বাড়ি ও বাড়ি ঝিয়ের কাজ করেন তিনি। এর মধ্যেই নিহত দুই ভাইয়ের ছেলেদের এতিমখানায় রেখে পড়ালেখা করালেও অর্থের অভাবে বছরে একবারো তাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয় না তার।
সামুদ্রিক ঝড় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিখোঁজ হওয়া মানুষের কোনো সন্ধানই পাননা স্বজনরা। নিখোঁজদের ফিরে আসার অপেক্ষায় কাটান বছরের পর বছর। দারিদ্র্যতার ঘানি টানতে থাকা এসব মানুষ নিজেরাও জানেন না কে কোথায় হারিয়ে যাবেন আগামী দুর্যোগে। নিজেই কি পারবেন বেঁচে থাকতে? আর দুর্গম জায়গা হওয়ার কারণে কোনো প্রকার সহায়তা কিংবা প্রশিক্ষণ পাননা তারা।
সমুদ্র তীরবর্তী দরিদ্র এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা মৎস্য শিকার। আর মৎস্য শিকারে যাওয়া এসব জেলেদের পোহাতে হয় দুর্যোগের নিষ্ঠুর অত্যাচার।
বরগুনা সদর উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের পারুল বেগম। স্বামীর খোঁজে রোজ বসে থাকেন বিষখালী নদীর পাড়ে। দুই বছর আগে, স্বামী রহিম মিয়া মৎস্য শিকারে গিয়ে সামুদ্রিক ঝড়ে নিখোঁজ হন। দুই বছর ধরেই পারুল বেগম অপেক্ষা করছেন ফিরে আসবে তার স্বামী। সেই অপেক্ষাই এখনও দিন কাটে তার।
তার মতই সাগরের আকস্মিক ঝড়ে নিখোঁজ রয়েছেন রাজিয়া বেগমের স্বামী জব্বার। এখন নদীর পাড়ে এলেই ভয়ে আঁতকে ওঠেন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গাঙ পারে আইলে বুকটা খা খা করে। তবে তিনি এখনো অপেক্ষায় রয়েছেন একদিন ফিরে আসবে জব্বার।
শুধু তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামেই নয় গোটা উপকূল জুড়ে এমন স্বজনহারাদের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাদের স্বজন নিখোঁজ রয়েছেন। বাড়ি ফেরার আশায় আশায় কেটে যায় যুগ-যুগান্তর। কোনো প্রকার সহায়তা তো মেলেইনা, উল্টো নিজ জীবন বাজি রাখতে হয় যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায়। এর ওপর বিষখালীর অব্যাহত ভাঙন, জোয়ার, জলোচ্ছ্বাস তো রয়েছেই।
সামুদ্রিক ঝড়ে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিখোঁজ পরিবারের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারো কাছে না থাকলেও বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনের হিসেবে গত দশ বছরে শুধু বরগুনা জেলায় এই সংখ্যা এক হাজারের ওপরে। তবে এই নিখোঁজের সঠিক পরিসংখ্যানের দাবি স্থানীয় সচেতন মহলের।
বরগুনা সদর উপজেলার সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কার ফোরামের সদস্য রুবেল চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের উপকূলীয় মানুষের জন্য সহায়তাও তো সরকার কম করে না। তাহলে সেগুলো যায় কোথায়? কিছু অসাধু মানুষের হাতে পরে ত্রাণ ও সহায়তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। আর এখন পর্যন্ত সরকার কিংবা কোনো উন্নয়ন সংস্থাই সাগরে আকস্মিক ঝড়ে নিখোঁজদের তালিকা করতে পারেনি।
এ বিষয়ে ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন অফ কোস্টাল এরিয়াস পিপলস (ডোক্যাপ)-এর নির্বাহী প্রধান মাসুদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তরাই থেকে যায় সহায়তার বাইরে। এর পেছনে জিও-এনজিওর সমন্বয়ের অভাব ও সরকারের কিছু অসাধু ব্যক্তিদের অসৎ উদ্দেশ্যই মূখ্য।
তিনি আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের শুধু অর্থ সহায়তা নয়, তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা উচিৎ।
বিভিন্ন দুর্যোগে স্বজনহারা এসব পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়ে জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, উন্নয়ন সংস্থাগুলো সহায়তা করছে এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক তবে সহায়তার পাশাপাশি স্বাবলম্বী প্রকল্প না করা গেলে এই পরিবার গুলোকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। তাই সহায়তার পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে স্বাবলম্বী প্রকল্প বাড়ানোর তাগিদ দিলেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৫
আরএ