দুবলার চর (সুন্দরবন) থেকে ফিরে: গভীর রাত। দুবলার চরের অদূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে মাছ ধরায় ব্যস্ত ৫ জন জেলে।
মারাত্মক জখম অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা নৌকার দাঁড় বেয়ে দুবলার চরে যখন পৌঁছান, ততোক্ষণে রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন জেলেদের দু’জন। অপেক্ষাকৃত কম আহতরা তাদেরকে নিয়ে হাজির হন চরের ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে। যেখানে থাকেন সমুদ্র এলাকার জেলেদের একমাত্র প্রাণজাগানিয়া ডাক্তার।
নাম তার আবু ফয়সাল সুমন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সুমন বলেন, ‘জেলেরা দরজায় এসেই ও ডাক্তার! বাঁচান- বলে চিৎকার করতে থাকেন। গভীর রাতে পাঁচজন রক্তাক্ত মানুষ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও বুঝতে বাকি থাকে না, তারা ডাকাতের শিকার। ত্বরিৎগতিতে সকলকে ঘরে বসিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া শুরু করি। কিন্তু গুরুতর আহতদের অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। ততোক্ষণে খবর পেয়ে জেলেদের অভিভাবক মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহমেদ একটি স্পিডবোট প্রস্তুত করে ফেলেছেন। ব্যান্ডেজ শেষ করতেই তাদেরকে নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন তার লোকজন। পরে শুনেছি, প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ায় কোনোমতে প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল তাদের’।
দুবলার চরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে জেলেদের চিকিৎসা সেবা বলতে এই প্যারামেডিকেল ডাক্তারই ভরসা। সামান্য কিছু ওষুধ আর একটি ছাপড়া ঘরে বসে জেলেদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মাছ ধরার মৌসুম এলেই লোকালয়ে পরিবারকে রেখে চলে আসেন সাগর মাঝের এই দ্বীপে।
ছাপড়া ঘরে কাঠের তাকে সাজানো সামান্য কিছু ওষুধ নিয়ে তার চেম্বার। বড় কোনো অসুখের চিকিৎসা দেওয়ার সাধ্য তার যেমন নেই, তেমনি নেই আরো বেশি পরিমাণ ওষুধ কেনার সামর্থ্যও। তবু যা আছে, তাই দিয়েই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন জেলেদের।
বাংলানিউজকে ফয়সাল বলেন, ‘জেলেদের জীবন অত্যন্ত পরিশ্রম আর কষ্টের। এখানে কেউ অসুখে পড়লে চিকিৎসার জন্য যেতে হয় মংলা অথবা খুলনায়। এর মাঝে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। অনেকে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা যান। তাই এই বিশেষ মৌসুমে কয়েকটা মাস আমি এখানে চিকিৎসাসেবা দেই। সামান্য অর্থ নেই। যদিও তা ‘ফি’ নয়। কারণ, এটার ওপরে আমার সংসার চলে। আমার সামান্য বিদ্যায় যেটুকু পারি, জেলেদের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ’
স্থানীয় জেলেরাও জানান, এই একমাত্র ‘ডাক্তার চেম্বারে’র কথা।
‘যেকোনো সমস্যায় আমাগো একমাত্র ভরসা এই ডাক্তার। উনি না থাকলে একটা জ্বরের ওষুধ আনতেও মংলা যাতি হতো। এখান থেকে মংলাটাই আমাগো কাছে। সে আনতিও দিন পার হয়ে যায়’।
বয়সে তরুণ ফয়সাল বলেন, ‘লোকালয়ে হয়তো আরো বেশি আয় করা যেতো। কিন্তু চরে পড়ে থাকা এই মানুষগুলোর প্রতি আলাদা মায়া জমে গেছে। তাই প্রতি বছর মাছ ধরার মৌসুম হলে মনের অজান্তেই ব্যাগ গুছিয়ে এখানে চলে আসি’।
তবে অভিযোগের সুরও জেলেদের কণ্ঠে। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া থেকে মাছ ধরতে আসা আবুল কাশেম বলেন, ‘কেবল দুবলার চরে রাসমেলা এলেই আমাদের অস্তিত্বের কথা সরকারের মনে পড়ে। অন্য সময় কেউ জেলেদের কথা মনে রাখেন না। এখানে কতো অমানবিকভাবে আমাদের বসবাস- কে রাখে সে খবর! সরকারের পক্ষ থেকে একটা চিকিৎসা কেন্দ্র পর্যন্ত আমাদের জন্য নেই। ডায়রিয়া হলে একটা স্যালাইন জোটে না। সব রোগের জন্য ভরসা করতে হয় ফয়সাল ডাক্তারের ওপর। কিন্তু আমাদের প্রতি সরকারেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে’।
কাশেমের মতো অন্যান্য জেলেরাও মাছের মৌসুমে চরে সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার দাবি জানান।
ফয়সালের চেম্বারের আশেপাশে রয়েছে আরো কয়েকটি দোকান। নিজেরা জেলে না হলেও জেলেদের সঙ্গে মিশে গেছেন বলে জানান এসব দোকানদাররা। চরে যে কয়েকজন জেলেদের নিত্যদিনের চাহিদা মেটান তাদের একজন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে আসা মুদি দোকানি আব্দুল হালিম।
তিনি বলেন, ‘এখানকার জেলেরা অত্যন্ত গরিব। তাই খুব যে আয় বেশি হয়, তা নয়। তবু কেন জানি প্রতি বছর মালামাল সাজিয়ে বসে পড়ি। মৌসুম শেষ হলে ফিরে যাই। শুধু জেলে নয়, চরের প্রতিও এক ধরনের মায়া পড়ে গেছে’।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৫
জেপি/এএসআর
** সুন্দরবনে অবাধে গাছ কাটা ও হরিণ শিকার