জলে বাধা জীবন যাপনের এ চিত্র পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ি দোবরা ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইউনিয়নের সাতটি গ্রামেরই চারপাশে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে খাল-বিল।
বিলাঞ্চলের পদ্মডুবি, দাসপাড়া, মনোহরপুর, বিলডুমুরিয়া, সোনাপুর, দেউলবাড়ি ও উত্তর গাওখালী গ্রামের বেশিরভাগ এলাকায় সড়ক নেই। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে গ্রামগুলোর বাসিন্দারা শত শত বছর ধরে নৌকাযোগে খাল-বিল দিয়ে যাতায়াত করছেন। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে এক বা একাধিক নৌকা।
গ্রামগুলোর ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও গ্রামের কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। নৌ-পথে সহজ যোগাযোগের কারণে ওই নয়টি প্রাথমিক ও পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং তিনটি মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছে খালের তীরঘেঁষে। সেগুলো হচ্ছে- উত্তর গাওখালী, উত্তর গাওখালী আমভিটা, মনোহরপুর, মনোহরপুর সরকারপাড়া, সোনাপুর, বিলডুমরিয়া, পদ্মডুবি শিশুশিক্ষা ও পদ্মডুবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমভিটা বালিকা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ত্রিগ্রাম সম্মিলনী, মনোহরপুর, সোনাপুর ও বিলডুমরিয়া পদ্মডুবি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ডুমরিয়া নেছারিয়া আলিম, ডুমরিয়া নেছারিয়া বালিকা সিনিয়র ও মনোহরপুর মোহাম্মদিয়া দাখিল মাদ্রাসা।
উত্তর গাওখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী নিজেরাই বৈঠা বেয়ে ৬টি নৌকায় বিদ্যালয়ে আসছে।
তৃতীয় শ্রেণির শান্ত মল্লিক জানায়, সে দুই বছর ধরে নৌকা বেয়ে বিদ্যালয়ে আসছে।
পঞ্চম শ্রেণির রিতা রায় বলে, ‘প্রতিদিন খালে দুই মাইল নৌকা বেয়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করি। আমার নৌকায় প্রতিবেশী আরও চারজন শিক্ষার্থী থাকে’।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিলীপ রায় জানান, বিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থীর ৬০ থেকে ৬৫ জন নৌকা চালাতে পারে। যারা এখনো পারে না, তারাও একটু বড় হলেই শিখে যাবে। এ অঞ্চলের শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগেই সাঁতার শেখে। একটু বড় হলে তাদেরকে পরিবারের উদ্যোগে সাঁতার ও নৌকার বৈঠা চালানো শেখানো হয়।
উত্তর গাওখালী থেকে মনোহরপুরগামী নৌকায় কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, মনোহরপুর গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। বিলে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি-রবিশস্য ও কিছু জমিতে ধান চাষ হয়। ধান ও সবজি চাষ আর খালে-বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। কৃষকেরা নিজেদের উৎপাদিত সবজি স্থানীয় বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীর ভাসমান হাটে বিক্রি করেন। সেখান থেকে কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
হাটে সবজির ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় কৃষক পরিবারে অভাব-অনটন নেই। সচ্ছলতা ফিরে আসায় সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন কৃষকেরা।
মনোহরপুর সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস ঘরামী জানান, মনোহরপুরের তিনটি বিদ্যালয়ের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর সবাই নৌকায় বিদ্যালয়ে আসে। বেশিরভাগ দরিদ্র কৃষকের সন্তান ও যোগাযোগ দুর্গম হওয়ায় শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম। বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীত মৌসুমে খালে পানি কম থাকে। তখন জোয়ারের সময় শিক্ষার্থীরা নৌকায় বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করে। পুরো শীত মৌসুম জোয়ার-ভাটার অনুসরণে বিদ্যালয় বসে।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বিলাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করে। স্বাভাবিক কারণে উপস্থিতি কম। এ অঞ্চলের শিক্ষার মান উন্নয়নে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন।
ত্রিগ্রাম সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র খায়রুল ইসলাম বলে, ‘আমাদের বিলডুমুরিয়া গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, সড়ক নেই। সন্ধ্যার পর বাড়িতে বন্দি থাকি, অন্ধকারে কুপির আলোয় পড়াশোনা করি’।
দেউরবাড়ি দোবরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. ওয়ালিউল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ ইউনিয়নের ২৫ হাজার মানুষের ৮০ শতাংশের যাতায়াতের বাহন নৌকা। মনোহরপুর, বিলডুমুরিয়া, সোনাপুর ও পদ্মডুবি গ্রামের শতভাগ মানুষ নৌকায় যাতায়াত করেন। শহরে প্রতিটি বাড়িতে যেমন গাড়ি থাকে, তেমনি আমাদের গ্রামগুলোতে প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে নৌকা। সড়ক যোগাযোগের উন্নয়নে চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে অপ্রতুল বরাদ্দ দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়, বিশেষ বরাদ্দের প্রয়োজন’।
ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ শামীম কিবরিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘শিক্ষাবান্ধব সরকার বিলাঞ্চলে চাহিদামতো বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। শিক্ষার্থীরা নৌকায় যাওয়া-আসা করছে। তবে জন্ম থেকে পানির আশেপাশে বসবাস করায় ওরা সাঁতার জানে। এতো কষ্টের পরেও শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শিশুদের শতভাগ বিদ্যালয়মুখী করার চেষ্টা করে যাচ্ছি’।
‘এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য, সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন’।
বাংলাদেশ সময়: ০২৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৭
এএসআর