বিহঙ্গদ্বীপ রুহিতা শুঁটকিপল্লী থেকে ফিরে: ‘সকাল থেইকা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাম করি। আবার রাইতে সংসারের কাম করি।
শুধু পারভীন বেগমই নয়, আমেনা, খাদিজা, সুলতানা, মরিয়ম, ফিরোজা বেগমসহ অসংখ্য নারী ওই শুঁটকিপল্লীতে মাছ বাছাই করেন। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা সদর পাথরঘাটা ইউনিয়নের বিহঙ্গদ্বীপ সংলগ্ন রুহিতা গ্রামের ওই নারীরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিন-রাত কাজ করছেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সরকারিভাবে পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতেও এসব নারীরা এখনো স্বাস্থ্যসেবার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
সরেজমিনে রুহিতা শুঁটকিপল্লীতে গিয়ে জানা গেছে, এখানকার নারী পেশাজীবীদের কেউ কেউ কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে গেলেও অধিকাংশই যাচ্ছেন না। ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শুঁটকি মাছ বাছাই ও শুঁটকি শুকানোর কাজে তারা ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। দুর্গন্ধে পেটে নানাবিধ সমস্যাসহ শারীরিক এবং স্কিন জাতীয় সমস্যায় পড়তে হয় প্রান্তিক জনপদের এই নারীদের। অনেকে তাদের শিশু সন্তানদের নিয়েই কাজ করেন। মায়ের কারণে ওই শিশুরাও এ সকল সমস্যায় পড়ছে। অনেক শিশু আবার অল্প বয়সেই শুঁটকি বাছাইসহ নানা কাজ করায় তারাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।
তবে স্বাস্থ্যবিভাগের দাবি, মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ ও লোকবল রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তারা সার্বক্ষণিক মাঠ পর্যায়ে রয়েছেন। বরগুনা জেলা স্বাস্থ্যবিভাগের মতে, এসব শুঁটকিপল্লীতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। তা না হলে নারী- শিশুরা আরও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।
বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনঘেঁষা পশ্চিমে বলেশ্বর নদ ও পূর্বে বিষখালী নদী আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর মাঝে পাথরঘাটা উপজেলা। এখানকার অধিকাংশ মানুষ খেটে খাওয়া দিনমজুর বা মৎস্যজীবী। উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার মানুষ সব সময়ই দুর্যোগের সাথে লড়াই করেই বসবাস করেন। সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, ফণি, বুলবুল, আম্পান- সব কিছুই যেন তাদের জীবনসঙ্গী। শুধু ঘূর্ণিঝড়ই নয়, এখানে পরিবেশের ঝুঁকিতেও রয়েছেন বাসিন্দারা। পুরুষের পাশাপাশি নারী-শিশুরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে হওয়ায় শুঁটকিপল্লীগুলো বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
রুহিতা গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মাছ শিকার, মাছ বাছাই ও শুঁটকি করা তাদের জীবিকার উৎস। বিশেষ করে মাছ বাছাই করে শুঁটকি তৈরিতে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বেশি। তারা জানান, বাধ্য হয়েই সন্তানদের নিয়ে তারা কাজে আসছেন। নিজেদের পাশাপাশি ওই শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও জীবনের প্রয়োজনে এটা করতে হচ্ছে।
শুঁটকিপল্লীতে কাজ করা নারী শ্রমিক ফাতেমা বেগম, ফিরোজা বেগম ও পারভীন বেগম বলেন, ‘সারাদিন কাজ করি। হাতের চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া দুর্গন্ধে মাঝে মাঝে পেটেও সমস্যা হয়। সব সময় স্যালাইন ঘরে রাখি। এখন আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। ’
এতো স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন কেন- এমন প্রশ্নে তারা বলেন, ‘এ কাম না করলে খামু কি? মইর্যা বাইছা কামতো করতেই অইবে। ’ গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে যান কি-না- এ প্রশ্নে ফাতেমা বেগম বলেন, ‘বড় কোনো সমস্যা অইলে যাই। তয় পেট ব্যথা, হাত পায়ের চামড়ার সমস্যা অইলে যাই না। নিজেরাই চিকিৎসা করি। ’
বরগুনা জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক খান মো. সালামাতুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রান্তিক জনপদের মানুষের চিকিৎসায় জন্য সব সময়ই আমাদের লোকবল রয়েছে। নারী ও শিশুদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও চিকিৎসার দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু শুঁটকিপল্লীতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করাতো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। শুঁটকিপল্লীগৈুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি এবং নারী ও শিশুবান্ধব করা উচিত। ’
বরগুনার সিভিল সার্জন মো. হুমায়ুন শাহিন খান বাংলানিউজকে বলেন, শুঁটকি বাছাইয়ে সংক্রমিত হওয়া ছাড়াও পেটে পীড়াসহ শারীরিক নানাবিধ সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের নির্ধারিত পিপিই দরকার এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে শুঁটকি শুকানো ও বাছাই করা উচিত। ’
প্রথম পর্ব
** সারাদিন শুঁটকি বাইছা ২শ টাহা পাই!
দ্বিতীয় পর্ব
** মরলে মোগো মাডি দেবে খাস পুহুরের পাড়ে
তৃতীয় পর্ব
** খড়ের ঘরে আমেনার জীবন
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০২০
এনটি