তালতলীর তাঁতিপাড়া এলাকা ঘুরে: বরগুনার তালতলী উপজেলা শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পঞ্চিমে রাখাইনদের বসবাস। এ গ্রামের নাম তাঁতিপাড়া।
খাল, বিল, ঘের, বাড়ির আঙিনা থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ শামুক কুড়িয়ে যা পায় তা দিয়েই সংসার চলে। দৈনিক এক থেকে ১৫০ কখনো কখনো ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি করে। আবার কখনো কখনো ৫০ টাকা আবার কখনো পাওয়াও যায়না। বর্তমান করোনার পরিস্থিতিতে এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের দুর্দিন যাচ্ছে। করোনার প্রভাব পড়ায় এখন বেহাল অবস্থা রাখাইন পল্লীতে। আগের মতো শামুক কুড়াতে নামতে পারছেনা, আবার যাও পারছে শামুক বাজারে নিযে বিক্রি করতে পারছেনা।
দেশের উপকূলীয় বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলা। এখানে অধিকাংশ মানুষই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। এখানকার মানুষ মাছের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়াও রাখাইন আধিবাসীদের হাতে বোনা তাঁতশিল্পের কারণে ঐতিহ্য বহন করে এ উপজেলা। তাছাড়া পায়রা তাপবিদুৎ কেন্দ্র, পর্যটন কেন্দ্রসহ সম্ভাবনাময় এলাকা। আদিকাল থেকেই তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে অসচেতন।
সরেজমিন তালতলীর ঐতিহ্য বহন করা তাঁতিপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাখাইনদের জীবন-জীবিকার প্রথাগত পদ্ধতি এবং পেটের দায়ে কত কষ্ট করছে। নারী-পুরুষসহ শিশুরাও সমানতালে কাজ করছে। তবে তাদের কাজের ধরণ অন্যরকম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শামুক কুড়ান বিরামহীনভাবে। অনেকে এ পেশাকে অন্যভাবে দেখলেও রাখাইনদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য তারা ছাড়তে চান না।
উপকূলবর্তী তালতলী রাখাইন পল্লী ঘুরে দেখা যায়, এসব অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের জীবন যাত্রা। চোখে না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই।
কথা হয় ২২ বছরের রাখাইন পুত্র লাতেমোর সঙ্গে। পূর্ব পুরুষের মতো না হলেও দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও আর হয়ে ওঠেনি। নেমে পড়েন পুরাতন প্রথা অনুযায়ী শামুক কুড়িয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। বাবা হারিয়েছেন ৪ বছর বয়সে। মা এবং নানার সঙ্গে কাজ শুরু করেন। নানা-নানীর সঙ্গে মাও বয়সের ভারে নুব্জ হয়ে গেছে। আগের মতো শামুক কুড়াতে পারছে না। এখন সেই ২২ বছরের লাতেমোর হাতেই সংসারের বৈঠা। তারপরেও কষ্ট হলেও মা সালাখে ছেলের সঙ্গে শামুক কুড়াচ্ছেন।
লাতেমো বাংলানিউজকে বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খালে, বিলে ও বাড়ির আঙ্গিনায় আসা শামুক টোকাই। যা পাই তা বিক্রি করি ১০০-১৫০ টাকায়।
কথা হয় অল্প বয়সে বিধবা হওয়া রাখাইন নারী সালাখের (৫০) সঙ্গে। নিজের এবং ছেলে কুড়ানো শামুক নিজের বসত ঘরে বসে শামুক পরিষ্কার করছেন। মাঝে মধ্যে বৃদ্ধ বাবা-মাও কাজের সহযোগিতা করছেন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, স্বামী হারিয়েছি অনেক আগে। ছেলের বয়স যখন ৪ বছর তখন তাকে করে গেল এতিম আর আমাকে করে গেল বিধবা। পূর্ব পুরুষের পেশাও ছাড়তে পারছিনা। একমাত্র ছেলেও চার বছর থেকেই শামুক কুড়ানো শুরু করে। আমাদের সংসার চলে খুব কষ্টে। এখন করোনার কারণে একেবারেই কামাই নাই।
এ কাজে স্বাস্থ্যগত সমস্যা হয় কি না এমন প্রশ্ন করা হলে সালাখে বলেন, সারাদিন পানির সঙ্গে কাজ করতে হয়। শীত আর গরম সমান। ঠাণ্ডতো লেগেই থাকে। কি করার আছে পেটের জন্য তো কাজ করতে হবে।
বরগুনা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাগোনারীর নির্বাহী পরিচালক হোসনেয়ারা হাসি বাংলানিউজকে বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা এমনিতেই অবহেলিত। তারা শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে কিন্তু তাদের অন্তহীন দুদর্শদার দিকে কেউ তাকাচ্ছেনা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা যেহেতু এ দেশের নাগরিক তাই তারাও সবকিছু পাওয়ার অধিকার রাখে। এজন্য তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যাসহ সব কিছু দেখভালের দায়িত্ব সরকারের। দেশের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে তাদের টিকিয়ে রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২০
এনটি