এছাড়া ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি না করায় আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
আদালত বলেন, এ নিয়ে কত কথা বললাম! এখন লজ্জায় চোখ ঢাকি।
৫৬ মামলার ৮ তদন্ত ও ২ তদারকির কর্মকর্তা হাইকোর্টে হাজিরের পর বুধবার (৩০ মে) বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
গত ২৩ মে বেসিক ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ফজলুস সোবাহানের জামিন শুনানিকালে হাইকোর্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তলব করেন।
ফজলুস সোবহানের আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ব্যাংক ঋণ দেবে কি দেবে না সেটা তো নির্ধারণ করে বোর্ড। কিন্তু বলা হচ্ছে ফজলুস সোবহান তিনি সহায়তা করেছেন। কী করে তিনি সহায়তা করেছেন? ঋণ যাচাই-বাছাই কমিটির সকল নেতিবাচক মূল্যায়ন থাকা সত্ত্বেও তাকে দায়ী করা হচ্ছে। এই অঙ্কের টাকার ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা এই ভদ্রলোকের ছিল না।
এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, কিছুই করার ছিল না। যেন ধোয়া তুলসী পাতা! ঋণ প্রস্তাব বাতিল না করে, শাখার সুপারিশে মর্ডগেজ (বন্দকনামা চুক্তি) না রেখেই ঋণ অনুমতি দিয়েছেন।
তখন আদালত বলেন, আপনার এই বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বিমত নাই। সবাই লুটপাট করে খেয়েছে। এফআইআর হচ্ছে না কেন, চার্জশিট দিচ্ছেন না কেন? এ ধরনের মামলায় আড়াই বছর লেগে গেল? তাহলে কেমনে হবে?
জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, আমরা তো চেষ্টা করছি। আদালতের প্রতিটা আদেশের পর প্রত্যেক তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে বসেছি। তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি নেই।
তখন আদালত বলেন, আপনি তদন্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিচ্ছেন? ঋণ যাচাই-বাছাই কমিটির নেতিবাচক সুপারিশ থাকার পর ঋণ দেওয়ার কোনো বিধান নাই। আপনি তদন্ত কর্মকর্তাদের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। চার্জশিট দিচ্ছেন না কেন? নেগেটিভ ফাইন্ডিং থাকার পরও বোর্ড কীভাবে ঋণের অনুমতি দিল? সেই বোর্ডের কাউকে কেন আসামি করা হয়নি?
দুদক আইনজীবী তখন বলেন, দুদক বসে নেই। চিঠি দেওয়া হয়েছে প্রত্যেককে। তারপরও কোনো দুর্বলতা আছে কিনা আমরা দেখবো। আজকেই (বুধবার) সকাল ১০টা থেকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমি যতটুকু জানি প্রত্যেকটা বিষয় খতিয়ে দেখতে হচ্ছে।
আদালত তখন বলেন, আর কতদিন লাগবে খতিয়ে দেখতে? আড়াই-তিন বছর তো হয়ে গেছে।
তখন দুদক আইনজীবী জবাবে বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত আড়াই বছর হয়েছে। এই সময়ে একটি আদেশ ছাড়া আপনাদের প্রত্যেকটি আদেশ, পর্যবেক্ষণ দুদক পালন করেছে। শুধু একটা ছাড়া। সেটা হলো নির্ধারিত সময়ে চার্জশিট দিতে না পারা।
আদালত তখন বলেন, গত আড়াই বছরে ৫৬টি মামলার মধ্যে একটি মামলারও চার্জশিট দিতে পারেননি। লোকবল সঙ্কট থাকলে তো পাঁচটি মামলা দিয়ে তা ভালোভাবে করতেন। ঋণ যাচাই-বাছাই কমিটি ঋণ অনুমোদন দেয়নি, দিয়েছে বোর্ড। অথচ বোর্ডের কাউকে আসামিই করা হয়নি। বোর্ড সবকিছুর জিম্মাদার।
আদালত বলেন, আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেও পিক অ্যান্ড চুজ করেছেন। আমাদের এত পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনায় কী হয়েছে? জামিন দিলেও তো সে আদালতের অধীনে থাকবে। একটা লোককে কতবার জিজ্ঞেস করা দরকার? আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা?
এরপর আদালতের প্রশ্নের জবাবে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, গত বছর তদন্ত শেষ করে কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কমিশন থেকে নতুন করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এর মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাও বদল হয়েছে। এরপর বেসিক ব্যাংকের তৎকালীণ বোর্ডের সকল সদস্যের বক্তব্য নেওয়া শেষ হয়েছে। তদন্তের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি।
এ সময় আদালত বলেন, টাকার উৎস খুঁজতে হবে, এটার প্রয়োজন মনে করেন আপনি? টাকার উৎস বের করা সম্ভব না। ক্যাশ টাকা দিয়ে কেউ জায়গা, কেউ গয়না কিনে ফেলেছে। টাকার এই উৎস অনুসন্ধান সম্ভব না। তাহলে দুদক চেয়ারম্যান এবং একজন পরিচালক কিভাবে এ কথা বলেন? আপনাদের এই পারফর্মেন্সে আমরা হতাশ। এখন আমাদের জামিন দিতে হচ্ছে। সব আসামি এক এক করে বের হয়ে যাবে।
দুদক পরিচালক ইকবাল তখন বলেন, গত পরশু অনেক ডকুমেন্ট এসেছে।
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, তদন্ত শেষ পর্যায়ে বলছেন-এটা কি সেই ছোট গল্পের মতো। শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। তদন্তের বিলম্বে আমরা হতাশ। আড়াই বছর হলো এখনো তদন্ত সম্পন্ন করতে পারেননি। লোকবলের অভাব থাকলে ৫/৬টি মামলার তদন্ত করতেন।
তখন দুদক পরিচালক ইকবাল বলেন, শেষ পর্যায়ে। তবে কমিশনের সেঙ্কশন না পর্যন্ত শেষ বলা যাচ্ছে না।
জ্যেষ্ঠ বিচারক দুদক পরিচালককে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি মনে করেন টাকা আত্মসাৎ হয়েছে? উত্তরে ইকবাল বলন, হ্যাঁ, আত্মসাৎ হয়েছে।
তখন আদালত বলেন, তাহলে ঋণ গ্রহীতাদের গ্রেপ্তার করছেন না কেন?
জবাবে সৈয়দ ইকবাল হোসেনে বলেন, ঋণ গ্রহীতারা সমানে ঠিকানা পরিবর্তন করেন। যে ঠিকানা আমাদের কাছে অছে সে ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যায় না।
আদালত বলেন, এ ধরনের ব্যক্তিদের তো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দেখা যায়। টক শোতে তারা অংশ নেয়। ব্যাংকের এত অর্থ আত্মসাৎ হলো আর সেই ঘটনায় তদন্ত সংস্থা দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করতে না পারায় আমরা হতাশ।
ফজুলস সোবহানের আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহদমুদ বলেন, ফজুলস সোবহানের কোনো ক্ষমতাই নেই ঋণ অনুমোদনের। এরপরেও তাকে ৪৮টি মামলার আসামি করা হয়েছে। এসব মামলার এজাহারে অভিযোগ একই ধরনের। যে অভিযোগে মামলা করা হয়েছে যদি তার সাজাও হয় তা সর্বোচ্চ এক বছরের, কিন্তু প্রায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে সে জেল হাজতে আছে।
এরপরই ফজলুস সোবহানের ৬ মামলা এবং আরেক আসামি সিপার আহমেদের ৩ মামলায় করা জামিন আবেদনের ওপর বৃহস্পতিবার (৩১ মে) আদেশের জন্য দিন ধার্য রেখেছেন হাইকোর্ট।
দুদকের অপর আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, হাইকোর্টের এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দুদককে গড়তে সাহায্য করছে। আদালত বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার জন্য দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট থাকে। এ কারণে সবার সহযোগিতা দরকার। আমরা বোঝার জন্য, অনুধাবনের জন্য তদন্ত কর্মকর্তাদের ডেকেছি। এখন আর কি, যা দেখার দেখলাম।
বাংলাদেশ সময়: ২২২৫ ঘণ্টা, মে ৩০,২০১৮
ইএস/এমএ