এমনকি বারবার আলোচনায় এসেও প্যারোল কিংবা সাজা স্থগিতের বিষয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি। যা কেবল আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
তবে আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য ফের আবেদনের কথা ভাবছেন। কিছুদিনের মধ্যে হাইকোর্টে জামিন আবেদন এবং আপিল বিভাগে জামিনের জন্য রিভিউ আবেদন করার কথা জানিয়েছেন তারা।
আইনজীবীদের মতে, বিএনপি চেয়ারপারসন কেবল দুই মামলায় জামিন পেলে তিনি কারামুক্ত হতে পারবেন। একটি হলো ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। যেটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। অপরটি হলো জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা। যে মামলায় সাত বছরের দণ্ড হয়েছে। মামলাটির হাইকোর্ট বিভাগে আপিল বিচারাধীন।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বারবার দেখা করে তার পরিবার বলছে, তিনি শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় ভূগছেন।
অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ মামলাটিতে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন।
একই সঙ্গে খালেদার ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত।
সেই থেকে কারাবন্দি রয়েছেন খালেদা জিয়া। পরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া আপিল করেন। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি চেয়ে দুদকও আবেদন করেন।
খালেদা জিয়া, অন্য আসামিদের আপিল এবং দুদকের আবেদনের শুনানি শেষে একই বছরের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদার সাজা ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। বাকিদের সাজা বহাল রাখেন।
হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ আপিল বিভাগে আপিল করেন খালেদা জিয়া। এ আবেদনের সঙ্গে জামিনও চেয়েছেন খালেদা জিয়া। কিন্তু এ আবেদনটি এখনও শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হয়নি।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা
২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাতবছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত।
একই সঙ্গে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সাজা হয়েছে মামলার অপর তিন আসামিরও।
খালেদা জিয়ার পাশাপাশি দণ্ডপ্রাপ্ত অপর তিনজন হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
এর বিরুদ্ধে একই বছরের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করা হয়।
উপস্থাপনের পর গতবছরের ৩০ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে অর্থদণ্ড স্থগিত এবং সম্পত্তি জব্দের ওপর স্থিতাবস্থা দিয়ে দুই মাসের মধ্যে ওই মামলার নথি তলব করেন।
এরপর ২০ জুন বিচারিক আদালত থেকে মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ৩১ জুলাই বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ তার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন।
পরে আপিল বিভাগে জামিন আবেদন করেন। যেটি ১২ ডিসেম্বর খারিজ হয়ে যায়। তবে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলেছেন আদালত।
এখন এই খারিজ আদেশের পুর্নবিবেচনা চেয়ে আপিল বিভগে এবং এই মামলায় ফের হাইকোর্টে জামিন আবেদন করার কথা জানিয়েছেন খালেদার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।
তিনি বলেন, আমাদের হাতে রিভিউ করার সময় আছে। আমাদের রিভিউ করার চিন্তা আছে। এছাড়া আমরা আবার এ মামলায় হাইকোর্টেও জামিন চাইতে পারি।
আলোচনায় প্যারোল ও সাজা স্থগিত
২০১৯ সালের ৩১ মার্চ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, না, সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেখানে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। প্যারোলটা মামলা সংক্রান্ত ব্যাপার না। এটা একটা বিশেষ বিধান।
যখন একটি লোক চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন তার চিকিৎসা দরকার, আর আইন অনুযায়ী আদালতে জামিন পেতে তার অনেক সময় লেগে যেতে পারে। বা অনেক ক্ষেত্রে তারা সাজা বহাল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকার ইচ্ছা করলে তাকে প্যারোলে মুক্তি দিতে পারেন।
চিকিৎসার জন্য দিতে পারেন। বিশেষ কারণে দিতে পারেন। সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিকার সংরক্ষণ করা আছে। যে কোনো সময়ের জন্য প্যারোল দিতে পারেন।
খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, যারা নীতি নির্ধারক আছেন তাদেরও সিদ্ধান্ত দরকার হবে, যার জন্য তারও সিদ্ধান্ত দরকার হবে। স্ট্যান্ডিং কমিটি যদি তাকে পরামর্শ দেন, সে পরামর্শ অনুযায়ী তিনি প্যারোলে যাবেন কি যাবেন না এটা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
কয়েকদিন পর জামালপুরে এক অনুষ্ঠানে প্যারোল নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া যদি সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করেন, তাহলে বিষয়টি আমরা ভেবে দেখবো।
তিনি আরও বলেন, প্যারোলে মুক্তি পেতে হলে একটি সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আবেদন করতে হবে। তার প্যারোলে মুক্তির জন্য কোনো আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো পায়নি।
এরপর প্যারোলে মুক্তির জন্য খালেদা জিয়ার পক্ষে কোনো আবেদন করা হয়নি।
এ আলোচনার অনেকদিন পর চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ হয়। আপিল বিভাগে খারিজের কিছুদিন পর ৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট বারে এক সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম।
ওই সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারা মোতাবেক কোনো সাজার কার্যকারিতা শর্তহীনভাবে স্থগিত করার একমাত্র ক্ষমতা সরকারের হাতে। আমরা আশা করি সরকার প্রতিহিংসার পথ পরিহার করে আইনগতভাবেই চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারেন। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা।
‘তাই আমরা সরকারের কাছে অবিলম্বে খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ ৪০১(১) ধারা অনুযায়ী স্থগিত করে তার ইচ্ছামতো চিকিৎসা নিতে দেশে/বিদেশে সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। ’
গত ১২ জানুয়ারি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, সাধারণত সাজা সাসপেন্ড করা হয় অনেকদিন সাজা খাটার পরে সরকার বিশেষ বিবেচনায় এটা করে, করতে পারে। সে রকম কেস যদি তারা মেইক আউট করতে পারে, সেটা সরকারের ব্যাপার।
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বাংলানিউজকে বলেন, মামলাটা দুদক আইনে করা। দুদকের আইনে সাজা স্থগিতের বিষয়ে কোনো বিধান নেই। তাই এ মামলায় সাজা স্থগিতে সরকারের কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২০
ইএস/এমএ