ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ক্রিকেট

বাংলানিউজের মুখোমুখি/

ঈর্ষা, অপেক্ষা আর দেশ বদলে ফন বিক যেভাবে বিশ্বকাপে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, স্পোর্টস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২৩
ঈর্ষা, অপেক্ষা আর দেশ বদলে ফন বিক যেভাবে বিশ্বকাপে

ভারতের কলকাতা থেকে: কলকাতায় তখনও উৎসব চলছে। এর ভিড়েই দুদিনের জন্য আসবে নেদারল্যান্ডস।

দলের ম্যানেজারের কাছে যখন প্রথমবার সাক্ষাৎকারের আবদার পৌঁছেছে, তখন তিনি বিমানে উঠার দোরগোড়ায়। শুরুতে দেওয়া তাড়াহুড়োর সূচির দোহাইয়ের ফাঁকেই পরে ভদ্রলোকের স্বদিচ্ছাতেই লোগান ফন বিকের কাছে রাখা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে।

মাঝখানে কেবল ইডেনের সংবাদ সম্মেলন কক্ষে যাওয়ার পথে তাকে মনে করিয়ে দিতে হয়েছে ‘আমিই কিন্তু...’। লোগান পরে বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাহমুদুল হাসানকে বলেছেন তার বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নপূরণের লম্বা যাত্রা, বাকি দুই ফ্ল্যাটমেট যখন খেলতেন; তাদের ঈর্ষা করার কারণ। শুনিয়েছেন বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হওয়া মুহূর্তের রোমাঞ্চ, পথ বদলে যাওয়া ও আরও অনেক স্বপ্নের গল্প।

বাংলানিউজ: বিশ্বকাপ কেমন কাটছে?

ফন বিক: এক কথায় বললে অসাধারণ। ভারতের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব ঘুরে এখন কলকাতায় এসেছি। প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করছি এখানে। এই বিশ্বকাপে কিছু উত্থান-পতন ছিল; কিন্তু আমি সেখানেই আছি, যেখানে থাকতে চেয়েছি।

বাংলানিউজ: দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর অভিজ্ঞতা আপনাদের জন্য নতুন নয়। বছরখানেক আগেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হারালেন। এই জয়গুলোর পর ড্রেসিংরুম কেমন ছিল?

ফন বিক: সবার মধ্যে সন্তুষ্টির একটা অনুভূতি হয়েছে। ম্যাচটা শেষ করতে সবগুলো উইকেটই নিতে হয়েছে, অপেক্ষাটাও লম্বা ছিল তাই। কিন্তু যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছিলাম, তখন আমার চোখ ছিল বাকিদের দিকে; ওদের চোখেমুখে আনন্দের সঙ্গে মিশে থাকা গর্ব দেখছিলাম। একজন আরেকজনকে নিয়ে খুশি ছিলাম। সবার মধ্যে সন্তুষ্টি কাজ করছিল।

যখন ড্রেসিংরুমে ফিরলাম, ফোন অ্যালাউ ছিল না প্রায় এক ঘণ্টা। আমরা একটা কোনায় গেলাম, তখন পেছনে টিভিতে আমাদের জয়ের পরের উদযাপনের হাইলাইটস চলছিল; সবাই সবার দিকে তাকালাম, উচ্ছ্বাসে ভেসে গেলাম, পুরো ব্যাপারটা উপভোগ করলাম। এই মুহূর্তটা সারাজীবনের জন্য হৃদয়ে গেঁথে গেছে।

বাংলানিউজ: বিশ্বকাপ এলেই আপনারা কিছু না কিছু একটা করে ফেলেন। ডাচ ক্রিকেটে কি এবার কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এসব জয়?

ফন বিক: আমাদের আশা তো তেমনই। নেদারল্যান্ডসের পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণা যোগানো আমাদের এক নম্বর লক্ষ্য। ওরা হল্যান্ডের হোক অথবা পৃথিবীর অন্য কোনো জায়গার; আমরা চাই নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠুক।

তাদের দুর্দান্ত একটা ক্যারিয়ার আর অসাধারণ মুহূর্ত হোক। আমি যতবারই জাতীয় সংগীত গাই, হয়তো মাঠে গিয়ে জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করি; কিন্তু একই সঙ্গে চাই পরের প্রজন্ম যেন আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়।

বাংলানিউজ: বিশ্বকাপ খেলার জন্য আপনার তো দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এতগুলো বছর, আলাদা দেশ...

ফন বিক: একদম ছোট থাকতেই স্বপ্নটা ঠিক করেছিলাম। ২০১৫-তে নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপের সময় আমার বয়স ছিল ২৫ বছর; খুব করে খেলতে চেয়েছিলাম ওটায়। কিন্তু পারিনি। আমার দুজন খুব কাছের বন্ধু খেলেছে। এরপর ঠিক করলাম ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলবো নিউজিল্যান্ডের হয়ে।

অনেকটুকু কাছেও বোধহয় গিয়েছিলাম। কিন্তু সুযোগ পাইনি খেলার। অস্বীকার করবো না, নিউজিল্য্যান্ডের সুযোগ পাওয়ার মতো অনেক ভালো কিছুও করিনি। এই বিশ্বকাপটাতেও কিউইদের হয়েই খেলতে চেয়েছিলাম। সম্ভাব্য সব কিছু করেছি স্কোয়াডে জায়গা পেতে। কিন্তু ওই দলে সুযোগ পাওয়া বেশ কঠিন।

এরপর আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার যত এগিয়েছে, স্বপ্ন পূরণের ভিন্ন পথ খুঁজে বেড়িয়েছি। নেদারল্যান্ডসকে বেছে নিলাম। আমাদের সামনে সুযোগ এলো বাছাইপর্ব পার করে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়ার। আমি খুব খুশি ছিলাম যে এই স্বপ্ন পূরণ করায় অবদান রাখতে পেরেছি। এখানে আসতে পেরে আমি নিজেকে নিয়ে গর্বিত। স্বপ্নের শুরু হয়েছিল যেখানে, সেই ১০ বছরের বয়সের আমিও হয়তো এখনকার অবস্থা দেখে গর্বিত হবো।

বাংলানিউজ: আপনি যে দুজন কাছের বন্ধুর কথা বললেন, তারা হচ্ছেন টম ল্যাথাম ও ম্যাট হেনরি। তাদের সঙ্গে কাটানো সেসব দিন কেমন ছিল?

ফন বিক: চমৎকার দিন ছিল সেগুলো। চার বছর একসঙ্গে একটা ফ্ল্যাটে ছিলাম আমরা। একসঙ্গে খেতাম, অনুশীলন করতাম, ঘুরতে যেতাম। তখন আড্ডায় অনেক সময় কাটিয়েছি আমরা।

বাংলানিউজ: তাদের যখন জাতীয় দলে খেলতে দেখতেন বাসায় বসে, তখন কি খারাপ লাগতো না?

ফন বিক: সত্যি কথা বলতে চাই, আপনার প্রশ্নের উত্তরটা হচ্ছে খারাপ লাগতো। ওরা যখন নিউজিল্যান্ডের জার্সি গায়ে খেলতো, আমার জন্য সেটা দেখাটা কষ্টের ছিল। কারণ ওদের জায়গাটাতে আমিও থাকতে চাইতাম। কিন্তু সেটা পারছিলাম না। বাসায় বসে বসে টিভিতে ওদের দেখতে হতো।

ওই সময় যেমন অনেক মজা করেছি, একই সঙ্গে ঈর্ষাও ছিল; আমিও তাদের জায়গায় যেতে চাইতাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পৌঁছাতে আমার কিছুটা সময় লেগেছে। কিন্তু হাল ছাড়িনি। এরপর একটা পথ খুঁজে পেয়েছি।

এখন যখন ওদের বিপক্ষে খেলি, দুর্দান্ত সব অভিজ্ঞতা। এখনও আমরা একে অপরের পাশে থাকি। ম্যাচের আগে শুভকামনা জানাই, কেউ ভালো খেললে তাকে সাধুবাদ জানিয়ে মেসেজ পাঠাই। আমাদের বন্ধুত্বটা খুব গভীর। এটা দারুণ ব্যাপার যে আমরা তিনজনই এই বিশ্বকাপে আছি।

বাংলানিউজ: নেদারল্যান্ডসের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে চান, এই সিদ্ধান্তটা কখন নিলেন?

ফন বিক: ২০১৪ সালে প্রথমবার নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলেছি। কিন্তু এটা যেহেতু আইসিসির অ্যাসোসিয়েট দেশ, এখানে যতই ম্যাচ খেলি না কেন, আমার সামনে নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলার চেষ্টা করার সুযোগ সবসময় ছিল। স্বপ্নপূরণের ওই চেষ্টাটা আমি করে যাচ্ছি এখনও।

আমি যদি নিউজিল্যান্ডের হয়ে একবার খেলে ফেলতাম, তাহলে নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলতে তিন বছর অপেক্ষা করতে হতো। আমার আসলে কখনওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার আসেনি এ কারণে। এই মুহূর্তে আমি ডাচদের হয়ে খেলা উপভোগ করছি।

আমি ওই ক্রিকেটটাই খেলছি, যেটা খেলতে পছন্দ করি। দলে আমার একটা ভূমিকা আছে, যেটা পালন করতে খুব পছন্দ করি। যদি নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলার সুযোগ চলে আসে, তাহলে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন হয়ে যাবে আসলেই।

বাংলানিউজ: আপনার তো ক্যারিবিয়ান রুটও আছে। কখনো তাদের হয়ে খেলার কথা ভেবেছেন?

ফন বিক: আসলে ত্রিনিদাদের পাসপোর্ট নেই আমার। দাদা যখন ১৯৫১ সালে ত্রিনিদাদ ছেড়ে আসে, সম্ভবত উনার তখন নাগরিকত্বের মেয়াদ বাড়াতে হতো। যদিও তার সঙ্গে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত উনি মারা গেছেন আমি ২০ বছর বয়সে থাকতেই; তখনও কোন দেশের হয়ে খেলবো এ নিয়ে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার আসেনি।

তবে এটা সবসময় আমার মাথায় আছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলা সম্ভব কি না। এই জিনিসটা দেখবো যে কোনো সুযোগ আছে কি না। আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এখনও একটা বড় স্বপ্ন আছে- ত্রিনিদাদের কুইন্স পার্ক ওভালে খেলবো। আশা করি সামনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে পারবো। যদি সেটা পারি, ক্রিকেট নিয়ে প্রায় সব স্বপ্নই পূরণ হয়ে যাবে!

বাংলানিউজ: এই যে এত অপেক্ষা, এরপর যখন নিশ্চিত হলেন যে বিশ্বকাপটা খেলবেনই। ওই মুহূর্তটা কেমন ছিল?

ফন বিক: ক্রিকেট মাঠে পাওয়া সেরা অনুভূতি এটা। ভাসকে (ডি লিড) যেভাবে খেলতে দেখেছি। পরে সৌভাগ্য হয়েছিল জেতার রানটা নেওয়ার। এক রান দরকার ছিল এক বলে। তখন শরীরে যে রোমাঞ্চ, হাত কাঁপছিল, আপনার সতীর্থরা সবাই এসে জড়িয়ে ধরছে, আনন্দ করছে; কী একটা ব্যাপার।

এরপর ড্রেসিংরুমে যখন এমন একটা উচ্ছ্বাস থাকে ‘আমরা স্বপ্নপূরণ করেছি’,  ‘আমরা এমন কিছু অর্জন করেছি যেটা কেউ ভাবেনি’; এই অনুভূতি চমৎকার। ওই টুর্নামেন্ট আমাকে শিখিয়েছে- কালচার রুলস। যদি আপনার একটা ভালো সংস্কৃতি থাকে, সবকিছু সম্ভব।

আপনার দলে সুপারস্টার দরকার নেই। আপনার ১১ জন ক্রিকেটারের... না, না; ১১ জন নয়, পুরো স্কোয়াডের একটা স্বপ্ন আর লক্ষ্য যদি থাকে। ওটার পেছনে তারা ছুটে বেড়ায় একসঙ্গে, যার যার কাজটা করে দেয়। এরপর যখন স্বপ্নটা ছুঁতে পারবেন, চমৎকার ব্যাপার হবে। ওই টুর্নামেন্ট থেকে দুটি জিনিস পেয়েছি- একটা তো বিশ্বকাপে খেলতে পারা। দ্বিতীয়টা হচ্ছে- এই টুর্নামেন্ট আমাকে বিশ্বাসী করে তুলেছে।

বাংলানিউজ: আপনার ক্যারিয়ারের পরের ধাপটা তাহলে কী হতে যাচ্ছে?

ফন বিক: আইপিএল খেলা। আমি সবসময় এখানে খেলার স্বপ্ন দেখছি। টি-টোয়েন্টির পিনাকল হচ্ছে আইপিএল। যদি কোনো পথ খুঁজে পাই স্বপ্নটা পূরণের, তাহলে দারুণ হবে। কিন্তু এটাও দারুণ হবে যদি পরের পাঁচ বছর নেদারল্যান্ডসকে কোনো বিশ্ব আসরের সেমিফাইনাল বা ফাইনালে নিয়ে যেতে পারি; সেটা ওয়ানডে হোক অথবা বিশ ওভারের বিশ্বকাপ।

একটা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি বা ফাইফার পেলেও ভালো লাগবে। আসলে অনেক ছোট ছোট স্বপ্ন আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় লক্ষ্যটা হচ্ছে- আগামী পাঁচ ছয় বছর যত বেশি সম্ভব ক্রিকেট খেলে যাওয়া; যতক্ষণ শরীর বা মন ‘না’ বলে দেয়। কিন্তু এখন আমি যত বেশি সম্ভব হাইয়েস্ট লেভেলের ক্রিকেটটা খেলতে চাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২৩
এমএইচবি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।