ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ক্রিকেট

মালয়েশিয়া যাচ্ছে ‘ক্রিকেট আঙ্কেল’ বাহিনী

সোহানুজ্জামান খান নয়ন, স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৪
মালয়েশিয়া যাচ্ছে ‘ক্রিকেট আঙ্কেল’ বাহিনী ছবি: শোয়েব মিথুন / বাংলানিউজটোয়েন্টি.কম

ঢাকা: শীতের চাদরে ঢাকা কলাবাগান ক্রিকেট ক্লাব মাঠে প্রায় ২০-৩০ জন তরুণ লাল-সবুজ জার্সি পরে ঘাম ঝরাচ্ছিলেন। ব্যাটপ্যাড আশেপাশে আছে দেখে বোঝা গেল ক্রিকেট খেলতে এসেছেন তারা।

কিন্তু শুধু ব্যাট ঘুরিয়ে আর বল মেরেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন না তরুণরা। তাদের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া, ক্রিকেট নিয়ে তো বটেই দেশ নিয়েও। আর তাদের পথ দেখাচ্ছেন ৫৮ বছরের এক তরুণ- শুরুতেই নাম জানার প্রয়োজন পড়ল না। সবার কাছে তিনি পরিচিত ‘ক্রিকেট আঙ্কেল’ নামে। সবার চোখের আড়ালেই গড়া নিজের অ্যামেচার ক্রিকেট ক্লাব (এসিসি) নিয়ে যাচ্ছেন মালয়েশিয়া সফরে।

ক্লাবের পুরো নিজস্ব অর্থায়নে রোববার বিকেলে মালিন্দো এয়ারলাইন্সে ১৫ সদস্যের দল নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সেখানে গিয়ে তিনটি আমন্ত্রণমূলক ম্যাচ খেলবেন। প্রথম ম্যাচটি হচ্ছে ৩৫ ওভারের, প্রতিপক্ষ মালয়েশিয়া ক্রিকেট প্রেসিডেন্ট একাদশ। পরের ম্যাচে তারা ফ্ল্যাডলাইটের আলোয় খেলবে টি-টোয়েন্টি। প্রতিপক্ষ সেলানগোর ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন একাদশ। শেষ ম্যাচটি হবে একদিনের ক্রিকেট, প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ মালয়েশিয়া ক্রিকেট প্রেসিডেন্ট একাদশই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী।

অপেশাদার এই দলে সদস্য ১০০ জন। এদের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ১৫ জনের সঙ্গী বেছে নিতে খুব বেশি কাঠখোড় পোড়াতে হয়নি ক্রিকেট আঙ্কেলকে। পয়েন্টের ভিত্তিতে দুমাসের পর্যবেক্ষণ শেষে বেছে নিয়েছেন সেরাদের। নিজেও ছিলেন এই প্রক্রিয়ার মধ্যে। পয়েন্টের ক্যাটাগরি ছিল এক থেকে চারের মধ্যে। যথাসময়ে মাঠে খেলোয়াড়দের রিপোর্টিং করা, ড্রেস আপ, অসাধারণ ফিল্ডিং ও ভালো আচরণের জন্য এক পয়েন্ট। ২৫ রান ও প্রতি উইকেট নিলে দুই পয়েন্ট এবং ৫০ রান ও চার উইকেট অর্জনে চার পয়েন্ট। এভাবেই দিন শেষে নিজের শিটে পয়েন্ট হিসাব নিকাশ করছেন পেশায় ব্যবসায়ী এই শখের ক্রিকেটার।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুঁজে বের করে এনেছেন যারা শখের ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসে। দলের সবাই পড়ালেখার মধ্যেই আছেন। বেশিরভাগেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তবে এই ক্লাব শুধু ক্রিকেটের মধ্যে নেই। বিভিন্ন দাতব্য কাজ করে যাচ্ছে তারা। ঢাকা শহরে যানযটের প্রকোপ কমাতেও পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে এসিসির তরুণরা। এছাড়া যুবকদের স্বাস্থ্য সচেতনেও কাজ শুরু করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অ্যামেচার দলটি ঘুরে বেড়ায়। ইতোমধ্যে রংপুর, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর ও মাগুরায় গিয়েছে। সেখানে স্থানীয় ক্লাবদের সঙ্গে খেলেছে তারা। নিজেদের সেরা পারফরমেন্স দিয়ে ৭০-৮০ ভাগ ম্যাচই জিতেছে বলে জানালেন ক্রিকেট আঙ্কেল।

ক্লাবটি শুরুতে নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পায় ধানমন্ডি ক্লাব মাঠে। কর্তৃপক্ষ আর জায়গা দিতে পারছে না বলে চলে আসতে হয়েছে কলাবাগান মাঠে।

পেশায় ফোম ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসায়ী হলেও ক্রিকেটকে যে কতটা ভালোবাসেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল এই মানুষটির আইপ্যাডে। খেলায় তার সব রেকর্ড ধারণ করা হয়েছে সেখানে। ৩২ বছর ধরে শখের এই খেলায় নিজেকে উত্সর্গ করেছেন। অর্ধশত বছর পেরিয়েও এখনও অলরাউন্ডিং পারফরমেন্স ধরে রেখেছেন। ম্যাচগুলো ক্রীড়াঙ্গনের কোনো বড়সড় নয়, তিনি খেলে গেছেন ৫ হাজার ৭১৭ ম্যাচ। ব্যাট হাতে করেছেন ৭৩ হাজার ২৬৫ রান! আর বোলিং এই অলরাউন্ডার নিয়েছেন ২২ হাজার ৭০৪টি উইকেট।

নিজের পারফরমেন্স নিয়ে মূল্যায়ন,‘আমি যদি আমার তরুণ বয়স থেকে ক্রিকেট খেলতাম তবে আমিও একদিন বড় ক্রিকেটার হতে পারতাম। আমি জীবনে যে কাজেই হাত দিয়েছি সাফল্য এনেছি। এই এসিসি থেকেই একদিন বিশ্বমানের ক্রিকেটার তৈরি হবে, ইনশাল্লাহ। ’ তিনি আরও জানালেন,‘আমি মূলত বোলিং অলরাউন্ডার। আমার ক্রিকেটীয় কর্মকাণ্ড ধানমন্ডির ক্লাবপাড়ার সবারই জানা। এই একজীবনে শতকই আছে পাঁচটি। অর্ধশতকও কম নয়- ১১৭টি। ‘

তবে ক্যাচের সংখ্যা নেহাতই কম সেই তুলনায়- ৭৩২টি। কেন? তিনি জানালেন,‘শরীর ভার হয়ে যাওয়ায় সেটা কমে গেছে। ’ ক্যাচের সংখ্যা কমে গেলেও তার স্বপ্ন অনেক বড়। স্বপ্ন দেখেন তার দলের খেলোয়াড়দের কেউই একসময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখবে। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। তবে সফলতায় তার মূলমন্ত্র- সুস্বাস্থ্য। তিনি বলেন,‘স্বাস্থ্য ভালো না হলে মানুষের কোনো কাজে সফলতা আসা সম্ভব নয়। এজন্য প্রত্যেককেই সুস্থ সবল হয়ে উঠতে হবে। এজন্য মাঠে আসার কোনো বিকল্প নেই। আমরা যে কাজটি প্রথমে করে থাকি সেটা হলো তরুণ যুবক ছেলেদের মাঠে আনতে আগ্রহী করে তোলা। ’

সামাজিক কাজেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন ক্রিকেট আঙ্কেল। দলের তরুণদের নিয়ে সেই পথে এগিয়েও যাচ্ছেন,‘আমি খুব ছোটবেলা থেকে দাতব্য কাজে নিজেকে জড়িত রেখেছি। আমি প্রচার থেকে প্রসারেই বেশি বিশ্বাসী। আমার নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জে। সেখানে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। সেখানে আমার একটি টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা আছে। নরসিংদীতে আমরা কয়েকটা জমি দেখে রেখেছি। সেখানে আমাদের দলের একটা মাঠ ও এসিসির নামে একটি হাসপাতাল গড়ার ইচ্ছা আছে। বিষয়টিকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি এবং ফান্ড গড়েছি। ’

ক্রিকেটকে আরও বড় পরিসরে নিতে বয়সভিত্তিক দলও গড়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। অনূর্ধ্ব-১৩, ১৫ ও ১৯ দল গড়তে প্রকৃত মেধাবীদের তৃণমূল থেকে তুলে এনে একাডেমির মাধ্যমে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন।

তার সম্পর্কে প্রিমিয়ার ক্রিকেট দল কলাবাগান একাডেমি কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন,‘এই মানুষটিকে দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেটের সঙ্গে থাকতে দেখেছি। দেশে থাকলে সকাল হলেই তিনি মাঠে আসেন। খুবই সাধারণ সাদাসিদে এই মানুষ। দলবল নিয়ে ক্রিকেটকে ‍দারুণ উপভোগ করেন। তার নামটি আসলে জানা হয়নি। ক্রিকেট আঙ্কেল নামেই ডাকে সবাই। আমিও এই নামেই চিনি। উনার মতো লোক ক্রিকেটের সঙ্গে যদি আরও বড় পরিসরে এগিয়ে আসে ক্রিকেট উন্নয়নে সহায়ক হবে। ’  

খেলোয়াড়দের উদ্দীপনা বাড়াতে মাঠেই উদ্যোগ নিয়ে থাকেন ক্রিকেটের এই আঙ্কেল। প্রথমে সবাইকে নিয়ে হালকা ব্যয়াম করে শরীর গরম করেন। এরপর প্যাড-গ্লাভস হাতে নিয়ে শুরু হয় অনুশীলন। পারফরমেন্সের ভিত্তিতে বিভিন্ন পুরস্কারে পুরস্কৃত করেন দলের সদস্যদের। তাকে কেউ আউট করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক পুরস্কার। দলের সেরা পারফরমারদের জন্যও থাকে বিশেষ আকর্ষণ। সময় পেলেই দলবল নিয়ে অনুশীলন শেষে চলে যান কোনো রেস্টুরেন্টে। সেখানে চলে ভুরিভোজন- স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে অল্পস্বল্পের মধ্যেই শেষ করেন।

শখ তো মজারই হয়। মজা করেই ক্রিকেট খেলে চলেছেন আঙ্কেল বাহিনী। তার পুরস্কার মিলল মালয়েশিয়ার টিকিট পেয়ে। সুশৃঙ্খল দলটি নিয়ে ভালো কিছু করতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাস খেলোয়াড়দের। বিদেশের মাটিতে নামডাক ছড়াতে পারলে হয়তো মালয়েশিয়া ছেড়ে অন্য কোথাও দেখা যাবে এই অপেশাদার ক্রিকেট দলকে।

সবার কাছে ক্রিকেট আঙ্কেল পরিচিতি পাওয়া মানুষটির নামের পেছনে কারণ জানা গেল তার কর্মেই। এবার আসল নামে আসা যাক। তার নাম- আবু ইলিয়াস জাবেদ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, ১২ জানুয়ারি ২০১৪
সম্পাদনা: ফাহিম হোসেন মাজনুন, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।