ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

টাইগারদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চার বিশ্বকাপ

তৌহিদুল আলম, স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৫
টাইগারদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চার বিশ্বকাপ ফাইল ফটো

ঢাকা: শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি শেষ, রাত পেরোলেই বিশ্বকাপ মিশন শুরু টাইগারদের। বুধবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ সময় সকালে সাড়ে ৯টায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে লড়াইয়ে মাঠে নামবে মাশরাফি বাহিনী।



বিশ্বকাপ মিশন শুরুর আগে এক পলক নজর দেওয়া যাক স্মৃতির পাতায়। আইসিসির ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার পর গত চারটি বিশ্বকাপে খেলেছে বাংলাদেশ। একটি বিশ্বকাপ ছাড়া প্রত্যেকটিতেই রয়েছে সুখস্মৃতি। সেই স্মৃতিগুলো এ বিশ্বকাপে টাইগারদের অনেক বেশি অনুপ্রেরণা-উৎসাহ যোগাবে।

পাকিস্তানকে হারিয়ে শুরুতেই চমক
১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে আয়োজিত বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নেয় বাংলাদেশ। সে আসরেই বিশ্বকে চমকে দেয় আমিনুল ইসলাম বুলবুলের দল।   গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে হট ফেভারিট পাকিস্তানকে হারিয়ে বাঘের গর্জন শুনিয়েছিলেন টাইগার ক্রিকেটাররা। তার আগেই তারা হারান স্কটল্যান্ডকে।

সেই বিশ্বকাপে বি গ্রুপে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, স্কটল্যান্ড এবং পাকিস্তান।

ওই বিশ্বকাপের স্মৃতিচারণ করে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল।   তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল স্কটল্যান্ডকে হারানো। সে লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পর পুরো টুর্নামেন্টই উপভোগ করেছি। তবে পাকিস্তানকে হারানো ছিল বিশেষ কিছু। সেদিন আমাদের দলের সবাই যেন চাইছিলো কিছু একটা হোক। ২২৩ রান স্কোর হওয়ার পর সুযোগটা কাজে লাগাতে পেরেছিলাম। ফলে বিশ্বকাপের প্রথম আসরেই ক্রিকেট বিশ্বকে আমরা চমকে দিতে সক্ষম হই। ’

পাকিস্তানে বিপক্ষে ব্যাট হাতে ২৭ রান এবং ৩১ রান দিয়ে তিন উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়েছিলেন বর্তমান দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজন।   তার মিডিয়াম পেস সামলাতেই  ৩১ মে নর্দহ্যাম্পটনে হিমশিম খেতে হয়েছিল পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের। সে ম্যাচ নিয়ে খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের পাঁচ উইকেট দ্রুত তুলে নিতে সক্ষম হলে বুঝতে পারি যে ওদের হারানো সম্ভব। আমরা ওদের সিঙ্গেল নিতে দিচ্ছিলাম না। কন্ডিশনের ব্যবহারটাও পুরোপুরি করেছিলাম। কোনো ক্যাচ মিস হয়নি। এক কথায় সেদিন আমরা স্বপ্নের মতো একটা ম্যাচ খেলেছিলাম।

বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। অথচ বিশ্বকাপ দল থেকে প্রথমে বাদ পড়েছিলেন তিনি। পরে সমর্থক, ক্রিকেট বিশ্লেষক এবং গণমাধ্যমে তার বাদ পড়া নিয়ে তোলপাড় হলে তাকে দলে নেওয়া হয়।

অবশ্য নিজেকে প্রমাণ করতে খুব বেশি সময় নেননি বাংলাদশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এ ব্যাটসম্যান। এডিনবরায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ২৬ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে দল যখন ধুঁকছিল, তখন তার অপরাজিত ৬৮ রানের ইনিংস বড় লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে উপরুন্তু দলকে ২২ রানের জয় পাইয়ে দেয়।

সেদিন বাংলাদেশ ৫০ ওভারে নয় উইকেটে ১৮৫ রান সংগ্রহ করেছিল। স্কটল্যান্ড অল আউট হয়ে যায় ১৬৩ রানে। মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ১২ রান দিয়ে এক উইকেট নিয়েছিলেন।

এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও খেলেছিলেন অপরাজিত ৫৩ রানের ইনিংস। সাবেক এই অধিনায়ক বিশ্বকাপে খেলেছিলেন চারটি ম্যাচ। ৭০ গড়ে করেছেন ১৪০ রান। তার স্লো মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে তুলে নিয়েছেন চার উইকেট।

সে টুর্নামেন্ট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ দলের বর্তমান এ নির্বাচক  বলেন, ‘প্রথম দিকে দল থেকে বাদ পড়ার পর মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু সুযোগ পাওয়ার পর তা কাজে লাগাতে পেরে সত্যিই ভালো লেগেছিল। বিশেষ করে ইংলিশ কন্ডিশনে ব্যাট করে সফল হয়েছিলাম বলে ভালো লেগেছিল।

ওই টুর্নামেন্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওপেনার মেহরাব হোসেন অপি খেলেছিলেন ৬৪ রানের অসাধারণ ইনিংস। সিমিং কন্ডিশনে কোর্টনি ওয়ালশ, মারভ ডিলিন, রেয়ন কিংদের নিয়ে গড়া পেসা অ্যাটাক সামলেছিলেন দুর্দান্তভাবে। ১২৯ বলে খেলে চারটি চার এবং একটি ছয়ে সাজিয়েছিলেন তার ইনিংসটি।  

বিশ্বকাপের কিছুদিন আগেই অপি ঢাকায় ত্রি-দেশীয় সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশক প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি উপহার দিয়েছিলেন। আবার বিশ্বকাপে প্রথম ফিফটিও আসে তার ব্যাট থেকে। অপি জানান, যে কোনো বোলিং অ্যাটাকের বিপক্ষে খেলার সাহসটাই তাকে এই সাফল্য এনে দেয়।

ওই বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার বিরোধিতা করে মন্তব্য করেন তৎকালীন কোচ গর্ডন গ্রিনিজ। সেই জেরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

তবে, ৩১ মে পাকিস্তানকে হারিয়ে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।

হতাশার দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ
দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়োজিত ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ছিল বাংলাদেশের জন্য চরম হতাশার। ওই টুর্নামেন্ট থেকে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে ফিরতে হয় টাইগারদের।

১১ ফেব্রুয়ারি ডারবানে বাংলাদেশ নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে আইসিসির সহযোগী কানাডার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। কিন্তু সেদিন খালেদ মাসুদ পাইলটের দল অপ্রত্যাশিতভাবে পুঁচকে কানাডার কাছে ৬০ হেরে গেলে ঈদ আনন্দ মাটি হয়ে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের।

সে ম্যাচে কানাডা টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে ১৮০ রানে অল আউট হয়ে গেলে মনে হচ্ছিল টাইগাররা বুঝি সহজ জয়ই পাবে। কিন্তু ১৮১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ২৮ ওভারের মধ্যেই ১২০ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ।

কানাডার হয়ে ছুটি নিয়ে খেলতে আসা সৌখিন ক্রিকেটার কলের মিস্ত্রী অস্টিন কডরিনটন ২৭ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে ধসিয়ে দেন টাইগার দলের ব্যাটিং লাইনআপ। অথচ, দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার আগে অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট লক্ষ্য সম্পর্কে বলেছিলেন, বি গ্রুপে কানাডা এবং কেনিয়াকেই  হারানো তাদের লক্ষ্য।

সে টুর্নামেন্ট নিয়ে প্রায় এক যুগ পর কথা হয় পাইলটের  সঙ্গে। তিনি বলেন, আসলে ওই টুর্নামেন্ট ছিল আমাদের জন্যে পুরোই হতাশার। এখনো ভাবলে মন খারাপ হয়। ওই বিশ্বকাপে আসলে কোনো কিছুই পরিকল্পনা মতো হচ্ছিল না।

কানাডা লজ্জার তিন দিন পর ১৪ ফেব্রুয়ারি পিটারমারিজবার্গে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। সেদিন চামিন্দা ভাস হ্যাটট্রিক সহ এক ওভারেই চার উইকেট নিয়ে ধসিয়ে দেন বাংলাদেশের টপ অর্ডার। প্রথম ওভার শেষেই বাংলাদেশের স্কোরকার্ড থেকে গচ্চা যায় চার উইকেট।

সে ম্যাচে সর্বোচ্চ ৩২ রান করেছিলেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান অলক কাপালি। তার সঙ্গে সে ম্যাচ নিয়ে কথা হলে বলেন, আমার কল্পনাতেও ছিল না এত তাড়াতাড়ি সেদিন ব্যাট করতে নামতে হবে, আসলেই আমরা খুবই বাজে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলাম।

সে ম্যাচে বাংলাদেশ ১২৪ রানে অল আউট হলে ১০ উইকেটে সহজেই ম্যাচ জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।

কানাডা-শ্রীলঙ্কার পর ১ মার্চ  তখনকার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কেনিয়ার কাছেও হারে বাংলাদেশ। টসে জিতে কেনিয়া প্রথমে ব্যাটিং করে। ইনিংসের তৃতীয় বলে সাফল্য পেয়েছিলেন পেসার মঞ্জুরুল ইসলাম। এরপর অহরহ ক্যাচ ম্যাচের মহড়া দেয় বাংলাদেশের ফিল্ডাররা। শেষ পর্যন্ত কেনিয়া সাত উইকেটে ২১৭ রান সংগ্রহ করে।

ব্যাটিং ব্যর্থতায় ৩২ রানে ম্যাচটি হেরে যায় বাংলাদেশ। ১৮৫ রানেই থেমে যায় পাইলটের দলের ইনিংস। সে ম্যাচ খেলানোর জন্যে  দেশ থেকে উড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল আকরাম খানকে। তিনি ৪৪ রানের ইনিংস খেলে চেষ্টা করলেও অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের কোন সহযোগিতা পাননি।

এই হারের ব্যাখা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান বলেন, কানাডার সঙ্গে ম্যাচটি হেরেই বাংলাদেশে মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়েছিল, যার ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি দল।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বৃষ্টির কারণে খেলা পরিত্যক্ত হওয়ায় ওই বিশ্বকাপ থেকে খালি হাতেই ফেরে বাংলাদেশ।

পুরো টুর্নামেন্টে ব্যর্থতার ব্যাখ্যা দিয়ে তৎকালীন অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট বলেন, কানাডার সঙ্গে ম্যাচে হারের পর আমরা কারো সঙ্গে কেউ দেখা করিনি, সবাইকে নিজেকে দায়ী মনে করছিল। সে সময় মোটিভেট করবে এমন কেউ ছিল না আশেপাশে। পরে এই হারের বোঝা বহন করতে পারেনি দল।

ওয়েস্ট ইন্ডিজে লাল-সবুজ রূপকথা
২০০৭ বিশ্বকাপে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশ আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাড়ি জমায় হাবিবুল বাশার সুমনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ। ৬ মার্চ প্রস্তুতি ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে দুই উইকেটে হারিয়ে টাইগাররা জানান দেয়, এবার কিছু একটা করতেই ক্যারিবীয় দ্বীপে পা দিয়েছে তারা।

সে ম্যাচে মাশরাফি বিন মুর্তজা ৪৪ রানে চার উইকেট নিয়ে ধসিয়ে দেন কিউইদের ব্যাটিং লাইনআপ। আবার ২২৭ রান তাড়া করতে নেমে যখন বাংলাদেশ বিপদে, তখন তার ১৪ বলে ঝড়ো ৩০ রানের ইনিংসের কারণেই  জয়ের মুখ দেখেছিল বাংলাদেশ।

২০০৭ বিশ্বকাপ দলে ছিলেন পেসার সৈয়দ রাসেল, তিনি বাংলানিউজকে বলেন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচটাই আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল।

এর দুই দিন পর ৮ মার্চ স্কটল্যান্ডকে ৭ উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে টাইগাররা তাদের চূড়ান্ত প্রস্ততি শেষ করে।

ভারতকে বলে-কয়ে হারানো
বাংলাদেশ যখন ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলার জন্যে তাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে- তখনই মাশরাফি, হাবিবুল বাশাররা জানতে পারলেন তাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন প্রিয় বন্ধু-সতীর্থ মানজারুল ইসলাম রানা।   সেই শোক নিয়েই মাঠে নামেন মাশরাফিরা।

ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে মাশরাফি বিন মর্তুজা বলেন, ভারতকে হারাতে পারলে ভালো লাগে সবসময়। ওই যে বিশ্বকাপে তাদের হারিয়েছি সে ঘটনা কিন্তু মনে করতে ইচ্ছে করে না, সে ম্যাচের কথা মনে হলে খালি রানার কথা মনে পড়ে।

১৬ মার্চ  পোর্ট অব স্পেনে শোকের প্রতীক  কালো ব্যাজ পরেই খেলতে নামে টাইগাররা। ম্যাচের আগের দিন ড্রেসিংরুমেই অধিনায়ক হাবিবুল বাশারকে মাশরাফি অনুরোধ করেছিলেন টস জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার জন্যে। তার সে কথাটাও বিখ্যাত হয়েছে, ‘টস জিতে ফিল্ডিং নিলে ভারতরে ধরা দেবানি’।

কথাটি যে শুধু ‘বাত কি বাত’ ছিল না তার প্রমাণ দেওয়া শুরু করেছিলেন নড়াইল এক্সপ্রেস নিজেই।   বন্ধুর শোকে মুহ্যমান এ স্পিডস্টারের আগুনে পোড়ে বীরেন্দ্র শেবাগ ও রবিন উথাপ্পার দল।

মাশরাফি শুরুটা করেছিলেন বীরেন্দ্র শেবাগকে দিয়ে। ম্যাচের তৃতীয় ওভারের প্রথম বল অফ স্ট্যাম্প পিচ করে যখন ইনকাটার হচ্ছিল তখনই মারতে গিয়ে বোল্ড হন  শেবাগ।

এরপরই ধারাভাষ্যকার বলছিলেন, ‘ইটস নট দ্য টাইম, ইটস নট দ্য শর্ট’। আসলে দিনটিই ছিল মাশরাফির। রবিন উথাপ্পাও দেখাতে চাইছিলেন ঔদ্ধত্য। কিন্তু পছন্দ হলো না নড়াইল এক্সপ্রেসের। সপ্তম ওভারের তৃতীয় বলে পয়েন্টে উথাপ্পাকে আফতাবের ক্যাচ বানালেন বাংলাদেশের পেসার। ভারতের রান দুই উইকেটে ২১।

এরপর দৃশ্যপটে আসেন বাঁহাতি স্পিনাররা। ১৫তম ওভারের শেষ বলে শচীনকে ফেরান রাজ্জাক, তখন ভারতের রান ৪০। মাস্টার ব্লাস্টার শচীন সেদিন ২৬ বল খরচ করে খেলেছিলেন সাত রানের এক ইনিংস।

এরপর ২৫তম ওভারের প্রথম বলেই রাহুল দ্রাবিড়কে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলেন মোহাম্মদ রফিক। শেষ পর্যন্ত ভারত অলআউট হয়েছিল ১৯১ রানে।

বিশ্বকাপের ম্যাচ দিয়ে ডেব্যু হয়েছিল ওপেনার তামিম ইকবালের। চট্টগ্রামের কিশোরটি যেন সেদিন খেলছিল তার পাড়ার মাঠে, জহির খান, মুনাফ প্যাটেল অজিত আগারদের সাবলীলভাবে খেলে কিশোর তামিম তুলে নেয় হাফসেঞ্চুরি।

ইনিংসের ১১তম ওভারে জহির খানকে পরপর দুটি চার মারার পর মিডউইকেটের  উপর দিয়ে উড়িয়ে মারতে ইয়ান বিশপের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসলো ‘হো হো...  ইট বিলাইজ এ সেভেনটিন ইয়ার্স ওল্ড রিয়েলি... শো ভেরি লিটল রেসপেক্ট টু এল্ডার স্টেটসম্যান। ’

তামিমের ৫৩ বলে ৫১ রানের ইনিংসটির কারণেই ম্যাচটি সহজ হয়ে গিয়েছিল এরপর আরো দুই কিশোর মুশফিক এবং সাকিবের ফিফটিতে পাঁচ উইকেটের  ঐতিহাসিক জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ।

বিশ্বকাপের দল ঘোষণার সময় তামিম, সাকিব, মুশফিকের অন্তর্ভুক্তিতে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। এবারের মতো তখনও প্রধান নির্বাচক ছিলেন সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ।   সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘২০০৭ বিশ্বকাপের দলে তামিম সাকিব এবং মুশফিককে নিয়ে আমি ঝুঁকি নিয়েছিলাম। জানতাম ওরা খারাপ করলে দায়িত্বটা আমাদের নিতে হবে। কিন্তু ‘ক্যালকুলেটিভ রিস্কটা’ কাজে লেগেছিল। আসলে মাঝে মাঝে এমন ঝুঁকি নিতে হয়। ’

এরপর শ্রীলঙ্কার কাছে ভারতের হার এবং সাত উইকেটে বারমুডার বিপক্ষে সহজ জয় নিয়ে প্রথমবারের মতো সুপার এইটে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ।

টাইগারদের প্রোটিয়া বধ
গায়নায় ৭ এপ্রিল সুপার এইটের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হয় আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে ৮৪ রানের মধ্যেই চার উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল হাবিবুল বাশারের দল। কিন্তু মোহাম্মদ আশরাফুল এবং আফতাব আহমেদের ৭৬ রানের পার্টনারশিপটাই বদলে দেয় ম্যাচের চেহারা।
 
আফতাব ৩৫ রান করে মাখায়া এনটিনির বলে আউট  হলেও আশরাফুল সেদিন খেলছিলেন তার স্বভাবসুলভ ইনিংস।   তার ১২ চারে ৮৩ বলে ৮৭ রানের ইনিংস বাংলাদেশকে এনে দেয় ২৫১ রানের পুঁজি। শেষদিকে মাশরাফি খেলেন ১৬ বলে ২৫ রানের ইনিংস।

আশরাফুলের ৮৭ রান এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপে কোন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান।

সেই ইনিংস নিয়ে কথা হয় আপাতত নির্বাসনে থাকা মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে। আশরাফুল সেদিনের পরিস্থিতির কথা স্মরণ করে বলেন, ‘প্রথম দিকে আস্তে আস্তে খেলছিলাম জানতাম একবার সেট হয়ে গেলে স্ট্রোক খেলতে পারব, শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। আর ওদের বোলাররাও এক সময় আমার পছন্দ মতো লেংন্থে বল করা শুরু করলে বাকি কাজটা সহজ হয়ে যায়। ’

২৫২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে সৈয়দ রাসেল, আব্দুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ রফিক এবং সাকিব আল হাসানের বোলিংয়ের জবাব দিতে পারেনি প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানেরা।   দক্ষিণ আফ্রিকা ১৮৪ অল আউট হয়ে গেলে ৬৭ রানের স্মরণীয় এক জয় পায় টাইগাররা।

সুপার এইটের শেষ ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের কাছে ৭৪ রানে হেরে নিজেদের সফল বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে বাংলাদেশ। সেদিন আগে ব্যাট করে আয়ারল্যান্ড বাংলাদেশকে ২৪৪ রানের টার্গেট দিয়েছিল। বাংলাদেশ অল আউট হয়ে যায় ১৬৯ রানে। তবে সে ম্যাচের টস শুরুর দশ মিনিট আগে সৈয়দ রাসেল ইনজুরিতে পড়লে তার জায়গায় খেলতে নেমেছিলেন শাহাদাত হোসেন রাজীব।

বর্তমানের নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমন ছিলেন ২০০৭ বিশ্বকাপ দলের অধিনায়ক। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য এসেছিল তার হাত ধরেই।   তবে এখনো আক্ষেপ আছে আইরিশদের বিপক্ষে ম্যাচটি নিয়ে, ‘আসলে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি না হারলে বলতে পারতাম আমরা শতভাগ সফল হয়েছি। সে ম্যাচে আসলে আমাদের মনমতো কিছু হয়নি। ’

তবে ২০০৭ বিশ্বকাপ দলের টিম স্পিরিট ছিল অসাধারণ। সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাবেক এই অধিনায়ক বলেন, ‘আমাদের ওই দলটা ছিল অন্যরকম, পুরো ট্যুরে একজনের সমস্যা হলে দশজন এগিয়ে আসত, ট্যুরটাও ছিল লম্বা। হয়তো  অনেকের দেশের কথা মনে পড়লে, কারো মন খারাপ হলে আরেকজন তার মন ভালো করার চেষ্টা করত এসবেরই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল মাঠের পারর্ফম্যান্সে। ’

ঘরের মাঠে টাইগারদের আক্ষেপ
২০১১ বিশ্বকাপের অন্যতম আয়োজক দেশ ছিলো বাংলাদেশ। জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দিয়েই হৃদয় জয় করে নিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বের। তার ওপর ছিল ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে ভালো ফলাফলের সুখস্মৃতি। বাংলাদেশ দলের লক্ষ্যটিও ছিল কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু পুরো টুর্নামেন্টে টাইগারদের পারর্ফম্যান্সে ছিল না ধারাবাহিকতা।

ইনজুরির কারণে মাশরাফি বিন মর্তুজাকে বাদ রেখেই দল ঘোষণা করেন বাংলাদেশের নির্বাচকরা। সে সময় মাশরাফির কান্না কাঁদিয়েছিল ভক্তদেরকেও। নড়াইল এক্সপ্রেস সে কঠিন সময়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘খুবই ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলতে পারব না, মানতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ’

বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে মিরপুরের শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে  ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় ভারতের। বি গ্রুপের ওই ম্যাচে দাঁড়াতেই পারেনি সাকিব আল হাসানের দল। আগের বিশ্বকাপের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল ভারত। বীরেন্দ্র শেওয়াগের ১৭৫ এবং বিরাট কোহলির ১০০ রানের ইনিংস মাহেন্দ্র সিং ধোনির দলকে এনে দেয় ৩৭০ রানের বিশাল পুঁজি।
 
জবাবে বাংলাদেশের দুই ওপেনার তামিম ইকবাল এবং ইমরুল কায়েস উড়ন্ত সুচনা এনে দিলেও শেষ পর্যন্ত স্বাগতিকরা সংগ্রহ করে নয় উইকেটে ২৮৩ রান। বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ৮৭ রানে ম্যাচটি হারে।

বি গ্রুপে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে ২৫ ফেব্রুয়ারি আয়ারল্যান্ডের মুখোমুখি হয় সাকিবরা। কিন্তু এদিন আইরিশরা স্বাগতিকদের ২০৫ রানে গুটিয়ে দিয়ে ২০০৭ বিশ্বকাপের পুনারাবৃত্তি ঘটানোর ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফিউল ইসলামের বোলিংয়ে বড় লজ্জার হাত থেকে রেহাই পায় বাংলাদেশ। ২৭ রানে ম্যাচ জিতে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ।

৪ মার্চ মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ রানে অল আউট হলে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে বড় লজ্জার সম্মুখীন হয় বাংলাদেশ। সেদিন স্টেডিয়ামে অনেক দর্শক আসার আগেই খেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নয় উইকেটে ম্যাচটি হারে বাংলাদেশ।

বাঘের থাবায় ইংলিশরা
১১ মার্চ চট্টগ্রামে  ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। টসে জিতে ইংলিশদের আগে ব্যাটিংয়ে পাঠান সাকিব। টাইগার বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ২২৫ রানে অলআউট হয়ে যায় ইংলিশরা।

২২৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে সহজ জয়ের পথেই হাঁটছিল বাংলাদেশ।   কিন্তু এক পর্যায়ে তিন উইকেটে ১৫৫ রান থেকে সাকিবদের স্কোর দাঁড়ায় আট উইকেটে ১৬৯ রান।

কিন্তু সফিউল ইসলাম এবং মাহমুদ্দল্লাহর ৫৮ রানের সময়োপযোগী পার্টনারশিপ দুই উইকেটের রুদ্ধশ্বাস জয় এনে দেয়।

ইংলিশ স্পিনার গ্রায়েম সোয়ানকে ওয়াইডিশ লং অনের উপর দিয়ে ছক্কাটিকে ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখেন সফিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ দেখলাম বলটা ফুলটস হয়ে গেছে, আসলে কুয়াশার কারণেই সে বলটা গ্রিপ করতে পারছিল না সুযোগটা নিলাম, এরপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

ম্যাচটিতে ৬০ রানের ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন ইমরুল কায়েস। তিনি  এখনও আফসোস করেন তার রান আউটটি নিয়ে। ওই ম্যাচের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আসলে রান আউটটা না হলে ইনিংসটা আরো বড় হত, আমি আর সাকিব সহজেই ম্যাচটা জিততে পারতাম। ওই অবস্থায় নতুন ব্যাটসম্যানের জন্য উইকেট বেশ কঠিন ছিল। আর তাই দ্রুত উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যাই আমরা। ’

এরপরের ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে ছয় উইকেটে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে এক পা দিয়েই রেখেছিল টাইগাররা। কিন্তু চেন্নাইতে ইংল্যান্ডের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জেতা ম্যাচ হেরে গেলে গ্রুপের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয় ছাড়া অন্যকোন উপায় ছিল না স্বাগতিকদের।

১৯ মার্চ গ্রুপের শেষ ম্যাচে  দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে হলে জয় ছাড়া উপায়  ছিল না সাকিবদের। সেই ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাট করে প্রোটিয়ারা আট উইকেটে ২৮৪ রান করে।
 
কিন্তু ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশ ৭৮ রানে অলআউট হয়ে যায়। সাকিব আল হাসান ৩০ রান করেন আর কোনো ব্যাটসম্যানই দুই অংকের কোটায় পৌঁছাতে পারেনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।