ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

আক্ষেপ সাঙ্গাকারার নয়, ক্রিকেট-বিশ্বের

অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২১ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৫
আক্ষেপ সাঙ্গাকারার নয়, ক্রিকেট-বিশ্বের ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেট যতোটা দেয়, তার কিছুটা বোধ হয় কেড়েও নেয়! পুরনো কথাটা মনে নতুন করে মনে পড়লো ওয়ান ডে ক্রিকেট থেকে কুমার সাঙ্গাকারার বিদায় দেখতে দেখতে। ক্রিকেট তাকে কতো কিছুই না দিয়েছে! কিন্তু দিলো না কেবল বিশ্বকাপটা হাতে নেবার সুযোগ! যদিও সেই বিশ্বকাপ-মঞ্চেই তিনি বিদায় জানালেন ওয়ানডে ক্রিকেটকে।

সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনেকে বিদায় নিয়েছেন। কারো বিদায় হয়েছে রাজসিক। কারো বিদায় ট্র্যাজিক। কুমার সাঙ্গাকারার বিদায়টাকে দ্বিতীয় তালিকায়ই রাখতে হচ্ছে। বিশ্বকাপে টানা চারটা সেঞ্চুরি করলেন। এখনো পর্যন্ত এবারের বিশ্বকাপে ৫শ’র উপরে রান করা একমাত্র ব্যাটসম্যান তিনি। অথচ বিশ্বকাপের প্রথম নক  আউট ম্যাচের পরই তিনি নেই!

‘থাকতে পারতাম। হয়তো আরো দু’একটা  বছর খেলা চালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু যেতেই যখন হবে, তাহলে বিশ্বকাপ খেলেই চলে যাওয়া ভাল। ’- সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ঐতিহাসিক প্রেস কনফারেন্স রুমে ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বললেন কুমার সাঙ্গাকারা।

ওয়ানডে ক্রিকেটে শচিনের পরই যার সবচেয়ে বেশি রান সেই লোকটার কি কোনো আক্ষেপ  থাকলো না বিশ্বকাপটা জেতা হলো না বলে!
 ‘আক্ষেপ! আক্ষেপ করার কিই বা আছে! আপনি জীবনে সব পাবেন তা কি হয়? এক ধরনের অপূর্ণতা বোধহয় জীবনকে পূর্ণতা এনে দেয়। ’ নিজের জীবন দর্শনটাকেই তুলে ধরলেন কুমার সাঙ্গাকারা। জীবন তার চলছে, চলবে। কিন্তু শরীরটা বোধহয় আর চলতে সায় দিচ্ছিলো না ক্রিকেটের পেছনে।   মধ্যে ত্রিশ পেরিয়ে আসা কুমার সাঙ্গাকারা সেটা বলেও ফেললেন। তার আগে নিজের গ্লাভস খোলা হাত দুটো দেখালেন গ্লাভস হাতে উইকেটের সামনে আর পেছনে দারুণভাবে সফল এই লংকান ক্রিকেটার। সেই হাতে যা দেখা গেলো তাতে একটা কথা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখতেই হচ্ছে ;‘ ক্রিকেটার হতে গিয়ে অনেক যন্ত্রনাও সইতে হয়। সেটা করতে রাজি থাকলে ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে বেছে নাও। না হলে আগে-ভাগে জীবনকে অন্য স্টেশনের দিকে ঘোরাও। ’

হ্যাঁ, সাঙ্গাকারার দু’হাতের এমন কোনো আঙুল দেখা গেল না, যেখানে টেপ জড়ানো নেই! ‘ ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে বিদায় নেয়ার পর এই আঙুলগুলো অন্তত একটু ভাল থাকবে। এতো টেপ জড়ানো লাগবে না। ’-বললেন শ্রীলংকার এই উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান। যিনি স্বপ্নের মতো একটা বিশ্বকাপ প্রায় দু:স্বপ্নের মতো করে শেষ করলেন! কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই তাঁর দল বিদায় নিলো। তাই বিদায় নিতে হলো কুমারকেও। কারণ আগেই বলে রেখেছিলেন তিনি, বিশ্বকাপের পর আর রঙীন পোশাকে ক্রিকেট নয়! জুন-জুলাই পর্যন্ত হয়তো টেস্ট ক্রিকেটটা খেলবেন। তাঁর পর ক্রিকেটকে পুরোপুরি বিদায় জানিয়ে দেবেন।
কিন্তু বিশ্বকাপে ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর নিশ্চয়ই নিজের ক্যারিয়ারটাকে একটু রিওয়াইন্ড করে দেখবেন তিনি। কিন্তু দেখতে দেখতে কোন বিষয়টা তাঁকে একটু বেশি আনন্দ দেবে, তৃপ্তি দেবে, পাবেন কিছুটা স্বস্তিও। ‘ অনেক, অনেক কিছুই থাকলো। কিন্তু আমার মনে হয় আনন্দ পাবো যদি দেখি দু’একজন মনে রেখেছেন। যদি কেউ বলে, হ্যাঁ, সাঙ্গার সঙ্গে খেলেছি। সাঙ্গার বিপক্ষে খেলেছি। আর যারা এতোদিন ভালবাসলেন ক্রিকেটার সাঙ্গাকে, তাঁরা যদি মানুষ সাঙ্গাকে মনে রাখেন তাহলে মনে হবে ক্রিকেট নামের খেলাটা খেলে ভুল করিনি জীবনে। ওটাই হবে বাকি জীবনের অনেক বড় প্রেরণা। ’ --বিদায়ী ভাষণের মতো করেই যেন বলে গেলেন শ্রীলংকান ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান।

তার চলে যাওয়াটা হয়তো আরো স্মরণীয় হতে পারতো। কিন্তু হলো না। সেজন্য দু:খও নেই কোনো। কথাটা খুব সাবলীলভাবে বলে গেলেন তিনি। তারপরও মনে হলো ভেতরের দু:খ আক্ষেপ যাতে কখনো মাথাচাড়া না দিয়ে ওঠে সেজন্য নিজের জন্য একটা অ্যালার্মও জারি রাখলেন এই বলে:  ‘ আমি নিজেকে মনে মনে বলি: ‘ কুমার তোমার চেয়ে অনেক অনেক বড় ক্রিকেটারদেরও চলে যেতে হয়েছে। যেতে হয়। সবাই সবকিছু পেয়ে বিদায় নিয়েছেন তা-ও নয়। মাঝারি মানের একজন প্লেয়ার থেকে হয়তো একটু ভাল প্লেয়ার হয়েছো তুমি--- দর্শক-সমর্থকদের ভালবাসায়। সেই ভালবাসার কথাটা মনে রাখলে, তোমার জীবনে কোনো আক্ষেপ থাকতে পারে না। ’

কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের জার্নিও শেষ স্টেশনে এভাবে নেমে যেতে হবে হারের দু:খ নিয়ে সেটা নিশ্চয়ই আগে ভাবেননি কুমার সাঙ্গাকারা। বিশ্বকাপকে সেরা মঞ্চ ভেবেছিলেন বিদায়ের জন্য। সেকথাটা বিদায় বেলাও বলে গেলেন। ‘ অবসরে নেয়ার জন্য বিশ্বকাপ ছিল ভাল উপলক্ষ্য। এরচেয়ে ভাল জায়গা  আর কি হতে পারতো!’ --জিজ্ঞাসা কুমার সাঙ্গাকারার। কিন্তু সেই বিশ্বকাপ নামের ট্রেনটা চলন্ত। কিন্তু সিডনিতে কোয়ার্টার ফাইনাল নামের স্টেশনেই পত্রপাঠ নেমে পড়তে হলো তাঁকে। বিশ্বকাপ ট্রেনের শেষ স্টেশন তো মেলবোর্ন! সেখানে থাকছে না শ্রীলংকা। থাকবেন না কুমার সাঙ্গাকারা। তবু মেলবোর্নকে তিনি মনে রাখতেই পারবেন। কারণ, ক্যারিয়ারের শেষবার যখন মেলবোর্নে খেলতে নেমেছিলেন, সেখানে সেঞ্চুরি করেছিলেন। ক্যারিয়ারের চারশতম ওয়ানডে উদযাপনটা এর চেয়ে আর ভালো কি হতে পারতো! সেই এমসিজিতে কুমার সাঙ্গাকারা নামের যে রান-এক্সপ্রেসটা ছুটতে শুরু করেছিলো, সেটা থামলো সিডনিতে। অনেকটা মন্থরগতিতে! ৯৬ বলে ৪৫ রান! কার নামের পাশে? কুমার সাঙ্গাকারা! বিশ্বাস হচ্ছে না! কুমার সাঙ্গাকারার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এখানে এসে  চমকে যেতে পারেন অনেকে। চমকানোর কিছু নেই। ৯৫ বলে ৪৫ রান। এটা নিছক দুটো সংখ্যা ছাড়া কিছু নয়! আর এইসব সংখ্যা দিয়ে কুমার সাঙ্গাকারার মতো ক্রিকেটারকে মাপতে গেলে ভুল হবে। বড় ভুল হবে। সেটা না করাই ভাল। কুমার সাঙ্গাকারার  বিদায়ে ক্রিকেটবিশ্বের একটু আক্ষেপ  হবেই ;‘ইস্‌, একজন ভদ্রলোক-ক্রিকেটার সরে দাঁড়ালেন ওয়ানডে থেকে!

বাংলাদেশ সময়: ১৭২২ ঘণ্টা, ১৮ মার্চ, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।