বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজ: রাত তিনটায় আমরা তিন বন্ধু লাইনে দাঁড়াই। কিন্তু সকালে পুলিশ এসে লাইন ভেঙে দেয়।
বাংলাদেশ-ভারত সিরিজ: মিরপুর স্টেডিয়ামের চার নম্বর গেট। গেটে পাহারারত সিকিউরিটি গার্ড। হাতে গোটা দশেক টিকিট। ১৫০ টাকার একেকটি টিকিট বিক্রি করছেন সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকায়। নিজ দায়িত্বের বাইরে আরেক দায়িত্ব নিয়ে বাড়তি পয়সা কামাচ্ছেন! টিকিট পেয়েছেন কিভাবে জানতে চাইলে বললেন, ভেতর থেকে। তারপর দ্রুতই ভেতরের দিকে চলে গেলেন।
বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ: লাগবে টিকিট.. গ্যালারি ৪শ’... একদাম ৪শ’! এমন স্লোগান দিয়ে পুলিশের সামনেই টিকিট বিক্রি করছেন কয়েকজন। তাদের ঘিরে জটলা পাকিয়েছেন কয়েকজন টাইগার সমর্থক। চলছে দরদাম।
উপরের দৃশ্যগুলো হোম সিরিজ চলাকালে বিভিন্ন সময়ে মিরপুরের চিত্র। এমন চিত্রের ধারাবাহিক দৃশ্যায়নে অনেক দর্শক অভ্যস্ত হলেও একেবারে নতুন যারা খেলা দেখতে আসেন তারা বাজে অভিজ্ঞতা ও হতাশা নিয়ে ফেরেন।
দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্য। ঘরের মাঠে সিরিজ আয়োজনও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশ দলের আকাশচুম্বি সাফল্যে ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনের প্রধান ক্ষেত্র। আর ক্রিকেটের প্রতি দর্শকের ভালোবাসাকে পুঁজি করেই চলছে টিকিট নিয়ে ব্যবসা।
ব্যাংকে যে পরিমাণ টিকিট ছাড়া হয় তার চেয়ে বেশি পরিমাণ টিকিট থাকে সৌজন্য বরাদ্দে। এখান থেকে অধিকাংশ টিকিট কালোবাজারে চলে যাওয়ায় ব্যাংকের চেয়ে কালোবাজারে টিকিটের পরিমাণ থাকে বেশি। একারণে ম্যাচের টিকিট হয়ে উঠেছে ব্যবসার একটি খাত। ফলে যাদের পকেট ভারী তারাই দেখতে পারছেন খেলা। আর ব্যাংকের বুথের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও একটা টিকিটের নিশ্চয়তা পান না সাধারণ কিংবা নতুন দর্শকরা। ফলে দিনে দিনে সাধারণ দর্শকের খেলা দেখার সুযোগ কমে আসছে। নির্ধারিত দামের চেয়ে তিনগুণ-চারগুণ টাকা দিয়ে টিকিট কেনার প্রস্তুতি না থাকলে খেলা দেখার ইচ্ছা পোষণ করাটা এখন নেহাত বোকামি!
টিকিট স্বল্পতা:
মিরপুরের শের-ই বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার। এর প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ টিকিটই বিক্রির জন্য নয়। অর্থাৎ সৌজন্য টিকিট। বিসিবি এসব টিকিট বিভিন্ন সংস্থা, মন্ত্রণালয়, প্রশাসন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সৌজন্য হিসেবে দিয়ে থাকে। সৌজন্য টিকিটপ্রাপ্ত সংস্থা থেকে অনেকেই লাভের আশায় এগুলো ছেড়ে দেন কালোবাজারিদের কাছে। ফলে সমর্থকদের চাহিদার তুলনায় ব্যাংকে টিকিটের যোগান থাকে অতি সামন্যই।
প্রস্তুত কালোবাজারিরা:
জিম্বাবুয়ে সিরিজের সবগুলো ম্যাচই (তিন ওয়ানডে ও দুই টি-টোয়েন্টি) মিরপুরে। সিরিজকে সামনে রেখে রমরমা ব্যবসার আশায় কালোবাজারিদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কালোবাজারি বলেন, ‘টিকিট ব্যবসায় বিরাট অঙ্কের লাভ থাকে। খেলার পরিস্থিতি বুঝে টিকিটের দাম ওঠে। পাকিস্তান সিরিজের সময় ৫শ’ টাকার টিকিট ২৫শ’ টাকায় বিক্রি করেছি। পুরো সিরিজে ৫০ হাজার টাকা আয় হয়েছে। জানি না এবার জিম্বাবুয়ের খেলা দেখায় দর্শকের আগ্রহ কতটুকু থাকবে। বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ক্রিকেট পাগল তাতে এবারও ব্যবসা মন্দ হবে বলে মনে হয় না। ’
শুধু সৌজন্য টিকিট সংগ্রহেই চোখ থাকে না এসব কালোবাজারিদের। ইউক্যাশের মাধ্যমে যে পরিমাণ টিকিট ছাড়া হয় তারও বড় একটা অংশও চলে যায় তাদের হাতে। এদের একেকজনের কাছে থাকে ৫০ থেকে ১০০টি করে সিম। ইউক্যাশে টিকিট ছাড়া মাত্রই আলাদা আলাদা সিম থেকে টিকিট নিশ্চিত করে ফেলেন তারা। এতে আধাঘণ্টার মধ্যেই ফুরিয়ে যায় টিকিট। পরের দিন ব্যাংকে গিয়ে সিরিয়াল নাম্বরগুলো কাগজে টুকে ব্যাংক থেকে টিকিট সংগ্রহ করেন তারা। বিক্রি করেন চওড়া দামে।
জিম্বাবুয়ে সিরিজে টিকিট ব্যবস্থাপনা নিয়ে কী ভাবছে বিসিবি? এ নিয়ে টিকিট অ্যান্ড সিটিং কমিটির প্রধান ইসমাইল হায়দার মল্লিককে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
গত সিরিজে মিরপুরের চিত্র :
টিকিটি নিয়ে কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য যেন একেকটি নতুন সিরিজ আগের সিরিজকে হার মানায়। পাকিস্তান, ভারত সিরিজের পর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ঘটেছে অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনা। বিসিবির টিকিট পার্টনার ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) মিরপুর রোড শাখায় দর্শকের চাপে হিমশিম খেতে হয় ব্যাংক কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের সামনে কোনো ব্যারিকেট না রাখায় লাইনের বাইরের লোকজন ঢুকে পড়ে ব্যাংকের ভেতর। এ সময় নারী পুলিশদের সঙ্গে নারী টিকিট ক্রেতাদের সংঘর্ষ বাধে। লাইন ভেঙে জোরপূর্বক ব্যাংকে ঢুকে যান তারা। পরে লাঠিচার্জ করে নারীদের লাইন ঠিক করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন পুলিশ সদস্যরা। জানা যায়, নারী টিকিট ক্রেতাদের অনেকেই টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত।
এ ব্যাপারে ইউসিবি ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার মো. ওয়ালীউল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার জানা মতে, বিসিবি ব্যাংকে মাত্র ৪ হাজার টিকিট দিয়েছে। তার মধ্যে ইউক্যাশে চলে গেছে ১০ শতাংশ টিকিট। আমি তিন বছর ধরে টিকিট নিয়ে কাজ করছি। সব টিকিটই ইউক্যাশে দেওয়া উচিত। তাহলে আমাদের ঝামেলা থাকে না, দর্শকদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয় না। ’
টিকিট ছিনতাই:
সিরিজ চলাকালে প্রায় ১০০ জনের মতো পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন স্টেডিয়ামের বাইরের শৃঙ্খলা রক্ষায়। তাদের সামনে দিয়েই কালোবাজারিরা অনায়াসে টিকিট বিক্রি করে যান। অভিযোগ আছে কতিপয় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও। তাদের আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিতজনদের জন্য টিকিট প্রয়োজন পড়লে দু-একজন কালোবাজারিকে ধরে টিকিট নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। আর গেটের দায়িত্বে থাকা সদস্যরা বিনা টিকিটে খেলা দেখার সুযোগ করে দেন পরিচিতজনদের।
এমনিতেই মিরপুর স্টেডিয়ামের আসন সংখ্যা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই কম। তার ওপর আবার প্রায় অর্ধেক টিকিটই দেওয়া হয় সৌজন্য! এই ধারা থেকে বের হওয়ার উপায় দেখছেন না বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসানও।
দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ চলাকালে টিকিট ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু সংস্থাকে টিকিট দিতে হয়। বোর্ড পরিচালকরা ৩০-৪০টা করে টিকিট নিচ্ছেন, কিনে নিচ্ছেন। এখানের স্টাফদের দিতে হচ্ছে, ক্লাবগুলোতে দিতে হচ্ছে- কাউকে না করতে পারছি না। বিসিবির কাউন্সিলরদের দিতে হচ্ছে। আগে সংসদের সব সদস্যরা পেতেন, এখন সাড়ে তিনশর মধ্যে বড় জোর ৫০-৬০ জন পান, যারা খেলা দেখতে আসেন। আগে সব মন্ত্রণালয়ে যেত, এখন নির্দিষ্ট কয়েকটা মন্ত্রণালয়ে যায়। ঢালাওভাবে কোথাও পাঠানো হয় না। রাজনৈতিক পর্যায়ে তো একেবারেই শূন্যের পর্যায়ে নেমে এসেছে। এটা আরও কমানো যেতে পারে কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ, চাহিদা অনেক বেশি। টিকিট নিয়ে সমস্যার সমাধানে ভবিষ্যতে অনলাইনে টিকিট ছাড়বো। ’
ভবিষ্যতে অনলাইনে টিকিট বিক্রির আশ্বাস বোর্ড সভাপতি দিলেও চলতি সিরিজেই কোনো টিকিট অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৫
এসকে/এমজেএফ