ত্রিদেশীয় সিরিজই না, সাকিব না থাকায় টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি সিরিজে টাইগার শিবির বিবর্ণ ছিল একথাও অনেকটা হলফ করেই বললেন এই টেস্ট স্পেশালিস্ট।
সাকিবহীন বাংলাদেশকে কি করে নাকানি চুবানি খাওয়াতে হয় মাত্রই বিদায় নেয়া কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের চাইতে ভালো আর কে জানে? করলেনও তাই।
বছরের শুরুতেই নিজ দলের বাজে পারফরম্যান্সের মূল কারণ হিসেবে দুটি বিষয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন টাইগারদের লিটল মাস্টার। বললেন আরো অনেক কিছুই। কবে বিয়ে করছেন, হাথুরুর সাথে স্নায়ু যুদ্ধের সময়টি কেমন ছিল, এদেশের তরুণ ক্রিকেটাররা কতখানি সম্ভাবনাময়।
বাংলানিউজকে দেয়া মুমিনুল হকের একান্ত সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো। দলের এই অবস্থা কেন?
মুমিনুল: যখন একটা দল খারাপ খেলে তখন এ অবস্থা হওয়া স্বাভাবিক। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই অবস্থা থেকে বের হওয়া। শুধু আমরা না, বিশ্বের যে কোনো দল যখন খারাপ অবস্থায় থাকে সেখান থেকে বের হওয়াটা তাদের জন্যও কঠিন হয়ে যায়। আশা করি সামনের সিরিজের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঘরের মাঠে এতটা বাজে খেললেন কেন?
মুমিনুল: দেখেন, আমিতো পুরো সিরিজ খেলিনি। শুধু টেস্ট খেলেছি। তাই আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। টেস্টের কথা বলতে পারি। আমার মনে হয় প্রথম ম্যাচ ভালো খেললেও দ্বিতীয় ম্যাচে বাজে ব্যাটিং করেছি। এই টেস্টে ভালো করতে পারলে টি-টোয়েন্টিতেও ভালো খেলতে পারতাম।
হেড কোচ নেই দেখেই কী দল ছন্নছাড়া অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে?
মুমিনুল: আমার কাছে মনে হয় না যে কোচ না থাকাতেই আমাদের এই অবস্থা। হাথুরু যখন কোচ ছিল এই প্লেয়াররাই খেলেছিল। আর সুজন ভাই তো সবসময়ই ছিল। ওরকম নেতিবাচক কিছু মনে হয় না। সমস্যা হলো আমরা যে দলের বিপক্ষে খেলেছি তারা আমাদের অনেক কিছুই জানে। এটা একটা বড় ফ্যাক্টর। হাথুরু আমাদের সম্পর্কে সব কিছু জানে বলেই ফায়দা নিতে পেরেছে। আমরা মূলত এখানেই পিছিয়ে ছিলাম। তবে আমাদের উচিত ছিল ওর ফায়দাটা নেয়া। কিন্তু আমরা সেটা পারিনি।
হেড কোচ বিদেশি হলে প্লেয়াররা ভয়ে থাকে ফলে পারফরম্যান্স গ্রাফও ওপরের দিকে থাকে। আর দেশি হলে রিল্যাক্স থাকে এবং গ্রাফ নামতে থাকে। আপনি একমত?
মুমিনুল: একথার সাথে আমি একমত না। যদি কোনো প্লেয়ার এভাবে ভাবে তাহলে সে পেশাদার না। কোচ যেই থাকুক, কোচ কোচই। তাকে কিন্তু সেভাবে সম্মান দিতে হবে। আর যদি কেউ সেটা না পারে সে বেশিদিন খেলতে পারবে না। কেননা দিন শেষে প্রতিটি প্লেয়ারের কিন্তু নিজের কাছেও নিজের জবাবদিহিতা থাকে। এভাবে কেউ ভাবলে সেটা তার জন্য যেমন ক্ষতি তেমনি দেশের জন্যও ক্ষতি। সাকিবের অনুপস্থিতি আপনাদের জন্য কতখানি ক্ষতির কারণ ছিল?
মুমিনুল: সাকিব ভাই না থাকাটা আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। টেস্টেও উনি না থাকাটা অনেক বড় ধাক্কা। টি-২০’তে না থাকাটাও অনেক বড় ক্ষতি। আপনি দেখেন ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল ম্যাচে ওনার ব্যাটিংটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উনি থাকলে ম্যাচের চেহারাই বদলে যেত। গত তিন চার বছর ধরে আমাদের সিনিয়রদের মধ্যে সাকিব ভাই নিয়মিত পারফর্ম করছে। ওই দিন রিয়াদ ভাইও ভালো ব্যাটিং করছিলো। তার সাথে সাকিব ভাইর জুটি হলে আমরা ম্যাচ জিতে যাই। এর আগেও কিন্তু আমরা এমন দেখেছি। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তারা দুজনই আমাদের ম্যাচ জিতিয়েছিল। সাকিব ভাই একসাথে দুইটা। ব্যাটিং-বোলিং। ওনার জায়গায় দুইটা প্লেয়ার লাগে। উনি থাকলে পুরো টিম কম্বিনেশনই বদলে যায়।
টি-টোয়েন্টিতে নতুনদের কেমন দেখলেন?
মুমিনুল: আমার কাছে ভালোই মনে হয়েছে। কারণ ওরা বিপিএলে পারফর্মার। প্রিমিয়ার লিগে রেগুলার পারফর্মার। আফিফ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ভালো ক্রিকেট খেলেছে। চেহারা দেখিয়ে কেউ দলে সুযোগ পায়নি।
ঢাকা টেস্টের ব্যাটিং দেখে প্রশ্ন উঠেছে আপনাদের মধ্যে আদৌ টেস্টের মেজাজ তৈরি হয়েছে কী না। সবই স্বাগতিকদের অনুকূলে ছিল, তারপরেও কেন আড়াই দিনে অলআউট হয়ে গেলেন?
মুমিনুল: খুব বাজে ব্যাটিং করেছি। এর আগেও আমরা তিন দিনে ইংল্যান্ডের সাথে জিতেছি, চারদিনে অস্ট্রেলিয়ার সাথে জিতেছি। কারণ ওই দুই ম্যাচেই আমরা ব্যাটিং ভালো করেছিলাম। ঘুরে ফিরে একটাই কথা সাকিব ভাই না থাকায় সব এলেমেলো হয়ে গেছে।
নতুন কোচ খুঁজছে বিসিবি। কেমন হলে ভালো হয়? হাথুরুর মতো কাটখোট্টা নাকি নরম সরম কেউ?
মুমিনুল: যেই হোক আমার কোনো সমস্যা নেই। বিশ্বের সেরা কোচ এনে দেয়ার পরেও আপনি যদি পারফর্ম না করেন, তার দেখানো কৌশল রপ্ত করতে না পারেন, লাভ নেই। মূল ব্যাপারটা হলো সে যা শেখাতে চাইছে আপনি তা শিখছেন কী না।
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি। অনুভূতিটা কেমন ছিল?
মুমিনুল: দেখেন, আমি না করলে যে কেউ করে দিত। আমার ভালো লাগছে। তবে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরির চাইতে আমার ভালো লাগছে ম্যাচটা বাঁচাতে পেরে। লিটনের ৯৪, রিয়াদ ভাই ও মিরাজের ব্যাটিংও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মূল ব্যাপার হলো আপনি ৩শ’ করেও ম্যাচ না জিতলে লাভ নেই। ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরির চাইতে ম্যাচটা বেঁচেছে এটাই বেশি তৃপ্তিদায়ক।
প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরির পর যেভাবে উদযাপন করলেন তাতে কাউকে দেখিয়ে দেয়ার কোনো ব্যাপার ছিল?
মুমিনুল: না, ওরকম কোনো চিন্তা থাকলে দ্বিতীয়টিতে করতাম। আমি অনেক দিন ধরে খেলি। দেখিয়ে দেয়ার কিছু নেই।
টেস্টে ৬ সেঞ্চুরির মধ্যে ৫টিই চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম কি তাহলে আপনার জন্য লাকি ভেন্যু?
মুমিনুল: হতে পারে। আল্লাহ হয়তো চান আমি ওখানে বেশি সেঞ্চুরি করি..(হাসি)। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পাইপ লাইন কতটুকু সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন। ৫ সিনিয়র চলে গেলে দলের অবস্থা কি হবে ভেবেছেন?
মুমিনুল: দেখেন কোনো কিছুই কারো জন্য থেমে থাকে না। একটা ব্যবস্থা হয়েই যায়। হয়তো শুরুতে সংগ্রাম করতে হয় পরে কিন্তু আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়।
ছয় বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে ২৭টি ম্যাচ খেলেছেন। কতটুকু তৃপ্ত? সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারতো না?
মুমিনুল: হলেও হতে পারতো। যদি ওভাবে আয়োজন হতো। তবে এতে আমার কোন কষ্ট নেই।
টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলে আপনার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস কোনটি?
মুমিনুল: সবচে ভালো লেগেছে চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসটা। ওদের পেসার ও স্পিনাররা খুবই ভালো বল করছিল। তাদের বিপক্ষেও ভালো ব্যাটিং করেছি। তার চাইতে বড় কথা হলো ম্যাচটা বাঁচাতে পেরেছি।
ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে কেন নিয়মিত হচ্ছেন না?
মুমিনুল: হয়তো আমাকে আরও অনেক জায়গায় ইমপ্রুভ করতে হবে। যদি কাভার করতে পারি তাহলে হয়তো দুই ফরম্যাটেই নিয়মিত হতে পারবো।
ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
মুমিনুল: জানি না। ক্রিকেট খেলছি, খেলতে থাকি। পরে দেখা যাবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কোন উচ্চতায় দেখতে চান?
মুমিনুল: অবশ্যই বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ জিতবে। আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কোনো অপূর্ণতা আছে?
মুমিনুল: না।
হাথুরুসিংহের সাথে আপনার একটি শীতল যুদ্ধ চলছিল। ওই সময়টা কেমন ছিল?
মুমিনুল: না, ওর সাথে আমার কিছুই ছিল না। আপনারা মিডিয়া এটা তৈরি করেছেন।
বিয়ে কবে করছেন?
মুমিনুল: আগামী এক দেড় বছরের মধ্যে।
তরুণ ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্যে কি বলবেন?
মুমিনুল: প্রথম কথা, ক্রিকেটটা উপভোগ করতে হবে। যে চাপ আসবে সেটা উপভোগ করতে হবে। জীবনটা চাপে ভরা। খেলাটা উপভোগ করলো চাপ বলে কিছু থাকবে না। ডেডিকেশনটা ঠিক থাকতে হবে। যেটা করবে সেটা যেন মনোযোগ দিয়ে করে এবং স্বপ্নটা সব সময় বড় দেখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
এইচএল/এমএমএস