তখন ইমরান তাকে অনেক রাগারাগি করে বললেন, ‘এটা তোমার কাজ না। তোমাকে আমি দলে নিয়েছি জোরে বল করার জন্য এবং তোমার যে জায়গা সেখানে বল করতে।
হলোও তাই ইমরানের ওই রাগান্বিত টিপসে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে তিনি একহাতে শাষন করেছেন। মূলত ওই সাক্ষাৎকারটিই মাশরাফির পেশাদার জীবনকে সমৃদ্ধ করণে মূল জ্বালানিটি যুগিয়েছে। মাশরাফি ওয়াকারের মতো কাঁপন ধরানো বিশ্ব সেরা সুইং মাস্টার হতে পারেননি ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের পেস বোলিংয়ের ইতিহাসে সেরা হতে পথ দেখিয়েছে।
নন্দিত এক পেস বোলার হতে মাশরাফি শুরুতে যেটা করেছেন সেটা একেবারে বেসিক। প্রথমেই স্পট ঠিক করেছেন, যে কোথায় তিনি বলটি ফেলবেন। এরপর সেখান থেকে বের করেছেন ভেরিয়েশন অর্থাৎ সুইং, কাটার, বাউন্সার এবং ইয়র্কার। তাতে কাজ হয়েছে বিস্তর। লাল-সবুজের ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাদের সেরা হয়েছেন।
বুধবার (৭ মার্চ) পড়ন্ত বিকেলে মিরপুর জাতীয় ক্রিকেট একাডেমির চত্বরে সংবাদ মাধ্যমকে নিজের সাফল্যের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে সেকথাই বললেন, ‘আমি যখন ছোট বেলা থেকে ক্রিকেট খেলা শুরু করি তখন আমি সবসময় জায়গায় বল করতে চাইতাম, পেস ওরকম ছিল না। এটাই এখনও আমার সঙ্গী। আমার স্ট্রেংথ বলতে যদি কিছু বলেন একটাই, আমি একটা জায়গায় বল করতে চাই। একটা জায়গার বাইরে আমি কিছু করতে চাই না। যদি ভেরিয়েশন কিছু করি সেটাও ওই জায়গার ভেতরে। এরপর ভাল খারাপ অন্য জিনিস। ’
হালের মোস্তাফিজ যে কাটার ছুঁড়ে থাকেন সেটা ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ ছুঁড়েছেন আজ থেকে এক যুগেরও বেশি সময় আগে। তবে ঘাতক ইনজুরি তাকে সেটা অব্যাহতভাবে ছুঁড়তে দেয়নি। ইনজুরিতে পড়েছেন আর বোলিংয়ের কৌশল বদলেছেন, ‘কাটার আমি ২০০৫ সাল থেকে শিখেছি এবং তখন থেকেই ওটা আমার স্ট্রেংথ। ইমপ্রোভাইস করা শিখেছি যখন আমি দেখেছি আমার জায়গা ঠিক আছে। যখন ইনজুরি আসছে তখন আবার ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে। ’
ক্যারিয়ারের পুরো সময়টা এমন ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেই ২০০১ এ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করা সেই তরুণ আজকের মাশরাফিতে পরিণত হয়েছেন।
বয়স ৩৪ পেরিয়ে ৩৫ এর দিকে ছুটতে শুরু করেছে, হাঁটুতে ৮ বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। অথচ বল হাতে আজও তিনি ব্যাটসম্যানদের দুঃস্বপ্নে বিচরণ করেন। অতটা গতি তার বলে নেই। কিন্তু এখনও তার লাইন ও লেন্থ কতটা নিখুঁত! সুইং, বাউন্সারে ব্যাটম্যানরা অক্কা পাচ্ছেন অহরহ।
ত্রিদেশীয় সিরিজের পর ঘরোয়া ক্রিকেটের চলতি মৌসুমে আবাহনীর হয়ে তার বোলিং তাণ্ডবে দেশের ক্রিকেটাঙ্গন তো হতবাক। তাকে নিয়ে মুগ্ধতা দিন দিন বাড়ছে, বৈ কমছে না। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের চলতি মৌসুমে ৮ ম্যাচে খেলে ইতোমধ্যেই তুলে নিয়েছেন ২৫ উইকেট। এতে করে তোপের মুখে পড়েছে আবু হায়দার রনির রেকর্ডটি।
গত মৌসুমে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের হয়ে তিনি নিয়েছিলেন ১৬ ম্যাচে ৩৫ উইকেট। মাশরাফির দল আবাহনী সুপার লিগ নিশ্চিত করে ফেলায় ম্যাচ পাওয়া যাবে আরও আটটি। ওই আট ম্যাচে ১১ উইকেট নিলেই দেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে নতুন রেকর্ডে নাম লেখাবেন তিনি। হবেন সর্বোচ্চ শিকারি।
এতো গেল ভবিষ্যতের কথা। গতকাল ফতুল্লায় অগ্রণী ব্যাংকের বিপক্ষে তার আশ্চর্য সুন্দর বোলিংয়ে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে দেশের প্রথম বোলার হিসেবে টানা চার বলে তুলে নিয়েছেন চার উইকেট। আর বিশ্বে অষ্টম। ম্যাচে তার মোট উইকেট ৬টি।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ঘরোয়া ক্রিকেটের এসব রেকর্ড তাকে সরাচর ছুঁয়ে যায় না। তবে কদাচিত কিছুটা মনের নিভৃত কোণে ভাললাগার পরশ বুলিয়ে যায়।
‘শোনার পরে অবশ্যই ভাল লেগেছে। যে কোনো ম্যাচই খেলেন আপনি যদি ৫ উইকেট পান, তিন উইকেট পান ওই অনুভূতি অবশ্যই আছে। কিন্তু আলাদা করে বলার মতো কিছু না। এগুলো আমাকে টাচ করে না। আন্তর্জাতিক ম্যাচ হলে ভিন্ন কথা ছিল। ’
ফতুল্লায় ওদিন ওমন বিধ্বংসী বোলিংয়ে ডাবল হ্যাটট্টিকসহ ৬ উইকেটের এমন অর্জনের চাইতে দলের জয়ই তার কাছে বড় হয়ে ধরা দিয়েছে, ‘একটা ভয় বারবরই লাগছিলো ম্যাচ হেরে যাচ্ছিলাম। আর পরপর দুই ম্যাচ হারলে পিছিয়ে যেতাম। যে কোয়ালিটির টিম আবাহনী হারলে খারাপ হতো। তো ওই অনুভূতিটা বেশি ভাল ছিল যে হারের জায়গা থেকেও ম্যাচটা জিততে পেরেছি। ’
এটাই মাশরাফি। নিজের চাইতে দল বা দেশের অর্জনই যার কাছে আগে। ওয়াকারের ওই সাক্ষাৎকার পড়ে হয়তো তার মতো বিশ্ব সেরা তিনি হতে পারেননি। কিন্তু দেশসেরা হতে পেরেছেন এটাই বা কম কিসে? তাছাড়া মাশরাফির ক্যারিয়ারের সূর্য এখনও অস্ত যায়নি। দেখাই যাক না নিজেকে বারবার ছাড়িয়ে যাওয়া এই টাইগার দিন বদলের দলপতি আর কাকে ছাড়িয়ে যান।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, ৭ মার্চ, ২০১৮
এইচএল/এমএমএস