শুরুতে ব্যাট করতেন লোয়ার অর্ডারে। সেখানে প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে ২০১৬ সালে উঠে আসেন তিন নম্বরে।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির এই রানের ধার ধরে রেখেছিলেন ওই বছরের বিপিএলেও। রাজশাহী কিংসের হয়ে বরিশাল বুলসের বিপক্ষে ৯ ছক্কা ও ৯ চারে অনবদ্য ১২২ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
টি-টোয়েন্টি দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা সেই সাব্বির আজ বাংলাদেশ ক্রিকেটের তিন ফর্মেটেই এক নির্ভরতার নাম। পারফরম্যান্স দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করে পরিণত হয়েছেন ওয়ানডে দলের অবিচ্ছেদ্য অংশে। টেস্টেও তা-ই।
ক্রিকেটের এই তিন ফর্মেটের মধ্যে টি-টোয়েন্টিই তার সবচে পছন্দের। পছন্দ করেন আগ্রাসী ব্যাটিং করতে। আগ্রাসী ব্যাটিং না করলে নাকি তিনি ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। ক্রিজের মধ্যেই অন্যমনস্ক হয়ে যান!
পেশোয়ার জালমির হয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেট পিএসএল খেলে এসেছেন। দেশের বাইরে এটাই তার প্রথম কোনো টি-টোয়েন্টি লিগ। সেখানে অনেক ক্রিকেট গ্রেটের সঙ্গেই তার দেখা হয়েছে। ওয়াকার ইউনুস, ইনজামাম উল হক থেকে শুরু করে স্যার ভিভ রিচার্ডস পর্যন্ত।
আশ্চর্য হলেও সত্য তারা এসে সাব্বিরের সাথে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন, টিপস দিয়েছেন, আদরও করেছেন। ভিভ রিচার্ড বলেই বসেছেন ‘কেন তুমি সিপিএল খেলো না?’ এসব বিষয় দারুণ আপ্লুত করেছে তাকে।
বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই অনন্য অনুভূতিই মেলে ধরলেন সাব্বির। জানালেন তার অগণিত নারী ভক্তকে সামাল দেবার কৌশলসহ আরো চমকপ্রদ বিষয়াদি। পাঠকদের জন্য সেসবেরই চুম্বক অংশ:
সামনে বাংলাদেশের অসংখ্য সিরিজ। আপনার লক্ষ্য কী থাকবে?
লক্ষ্য আগে যা ছিল এখনও তাই। অবশ্যই ভালো খেলা। আমার যে দুর্বলতা ছিল সেটা নিয়ে গত তিন মাস কাজ করেছি। গত একবছর যেকাজে আমি ব্যর্থ হতাম, যেমন ব্যাটিং কৌশলে কিছু সমস্যা ছিল, সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা করছি। ১৩ মে আফগানিস্তান সিরিজকে সামনে রেখে আমাদের ক্যাম্প শুরু হবে। চেষ্টা করছি ওই সিরিজটায় দুর্দান্ত কিছু করবো।
নিদাহাস ট্রফির পর লম্বা বিরতি। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে পারেননি। জাতীয় দলেরও কোনো ক্যাম্প ছিল না। নিজেকে কীভাবে ফিট রাখছেন?
নিজে নিজেই ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছি। জিম করছি, রানিং করছি। ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং নিয়েও কাজ করছি। ফলে ওভারঅল অনুশীলনটা আমার হয়ে যাচ্ছে। আমার বাসা রাজশাহীতে। পদ্মার বালুচরে এক সপ্তাহ কাজ করেছি।
আপনি একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়। শুধু ব্যাটিংই নয়, ফিল্ডিংয়েও আপনার দক্ষতা অসাধারণ। দলের প্রয়োজনে বোলিংও করেন। প্রতিভার প্রয়োগ কতটুকু করতে পেরেছেন?
বাংলাদেশ দলের হয়ে যতদিন খেলেছি আমার প্রতিভা আমি পুরোপুরি দেখাতে পারিনি। অনেক সময় অনেক ফিফটি মিস হয়েছে। অনেক সময় ক্যাজুয়ালি আউট হয়েছি। এখনও একটি সেঞ্চুরি করতে পারিনি। চেষ্টা করছি ভাল কিছু করতে। আমার রানক্ষুধা আছে। এজন্যই চেষ্টা করে যাচ্ছি।
বাংলাদেশের একমাত্র আগ্রাসী ব্যাটসম্যান আপনি। চট্টগ্রাম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আপনার ৬৬ রানের ইনিংসটি দেখার পর নাথান লায়ন বলেছিলেন আপনি বিরাট কোহলির মতো। এমন কম্পলিমেন্ট শুনতে কেমন লাগে?
কম্পলিমেন্ট তো মানুষ দেবেই! কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, আমার শক্তিমত্তা অনুযায়ী টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে আমি যেন খেলতে পারি। শুধু টি-টোয়েন্টিতেই নয়, তিন ফর্মেটেই আমার শক্তিমত্তা অনুযায়ী খেলতে চেষ্টা করছি। আমার শক্তির জায়গা হলো ব্যাটিং আগ্রাসন।
একজন ব্যাটসম্যানের জন্য আগ্রাসী হওয়া কতটুকু জরুরি?
সব ব্যাটসম্যান এক না। সবার ব্যাটিং স্টাইলও এক না। তাহলে তো ১১ জন ব্যাটসম্যান একই রকম হয়ে গেল। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রাসী থাকতে পছন্দ করি। আগ্রাসী না হলে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই। আর অন্যমনস্ক হয়ে গেলে রান করতে পারি না। নিজেকে অলস মনে হয়। কমফোর্ট ফিল করি না। ব্যাটিংয়ে নামলে প্রথম ১০ বলে যখন একটি বাউন্ডারি মারি আমার চাপটা কমে যায়।
আপনার প্রিয় শট?
স্লগ সুইপ
চার মারতে পছন্দ করেন নাকি ছয়?
ছয়।
শেষ কয়েকটি ম্যাচে দেখা গেছে আপনি কখনও তিনে, কখন চারে আবার কখনও ৬ এ ব্যাটিং করেছেন। আপনার পছন্দের অর্ডার কোনটি?
আমার তেমন কোনো পছন্দের জায়গা নেই। টিম যখন যেখানে খেলাতে চায় আমি সেখানেই খেলবো এবং খেলেছিও। ম্যাচের যে কোনো অবস্থায় যে কোনো পজিশনে আমি খেলতে পারবো।
টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি—এই তিন ফর্মেটের মধ্যে আপনি কোনটি খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
আমার মতো ব্যাটসম্যান টি-টোয়েন্টিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে চেষ্টা করবো তিনটি ফর্মেটেই যেন দেশের সেরা ব্যাটসম্যান হতে পারি।
বাংলাদেশ দলে এখনও সিনিয়র ব্যাটসম্যানরাই পারফর্ম করছে। তরুণরা যেমন আপনি, সৌম্য, মোসাদ্দেক কেন পারছেন না? অথচ আগে পেরেছেন। এখন কেন এমন হচ্ছে?
এই ভাবনাটি নিজে থেকে আসতে হবে। কেউ বলে দিলে হবে না। আমার সিনিয়ররা এখনও পারছে আমি পারছি না। দায়টা আমাদেরই।
নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৫০ বলে ৭৭ রান করেছিলেন। দল জিতলে নায়ক হতেন আপনিই। কিন্তু হেরে যাওয়ায় পারেননি। কতখানি কষ্টের ছিলো?
আমি রান করেছি বলে নয়, যদি না-ও করতাম এবং দল জিততো সেটাই বরং অনেক আনন্দের হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য হেরে গেলাম। বিশ্বাস করেন, শেষ দুই ওভারেও আমি ভাবছিলাম ট্রফিটা আমাদের হাতেই আছে। আমি অনেকদিন পর ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হবো, সংবাদ সম্মেলনে এসে কথা বলবো, টিমকে ভাল একটা অবস্থায় নিয়ে যেতে পেরেছি বলে গর্ববোধ করছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলে না। ক্রিকেট এটা হতেই পারে। তবে রান করে আত্মবিশ্বাসটা আবার ফিরে পেয়েছি।
পাকিস্তান সুপার লিগ পিএসএল খেলে এলেন। কেমন ছিলো?
এটা দেশের বাইরে আমার প্রথম কোনো ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি। অভিজ্ঞতা খুবই ভাল ছিল। ওয়াকার ইউনুস ছিলেন, আফ্রিদীর সাথে আমার ভাল সম্পর্ক; তিনি ছিলেন, ইনজামাম ভাই (ইনজামামুল হক) ছিলেন। আরও অনেক গ্রেট ব্যাটসম্যান আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস ছিলেন। উনি আমাকে চেনেন জানতাম না। আমাকে ডেকে বললেন, সিপিএলে (ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ) কেন নাম দাও না? আমরা তোমার মতো প্লেয়ারই তো খুঁজি। সবাই আমাকে চিনেছেন, আদর করেছেন, ডেকে কথা বলেছেন এটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
ওয়ানেড, টি-টোয়েন্টিতে আপনারা ভাল করলেও টেস্টে পারছেন না। সমস্যাটা কোথায়?
সবার কথা বলতে পারবো না। আমার কথা বলবো যে, টেস্টের টেম্পারামেন্ট (মেজাজ) হয়তো আরেকটু বেশি হলে ভাল হতো। তাহলে আমি আরও রান করতে পারবো এবং ক্রিজে থাকতে পারবো। টেস্ট এমনি এক খেলা যেখানে আপনি যতো বেশিক্ষিণ ক্রিজে থাকবেন ততো বেশি রান করতে পারবেন। তবে আমি বিশ্বাস করি, ৫ দিন খেলার মতো প্লেয়ার আমাদের আছে এবং আমরা খেলেছিও। শ্রীলঙ্কাতে শততম টেস্ট জিতেছি। হয় কি, মাঝেমাঝে ভাগ্য দলের সাথে থাকে না। হয়তো বা এই ক’দিন আমাদের খারাপ সময় গিয়েছে। সামনে আমরা আবার ভাল খেলবো।
আপনার চোখের (‘ক্যাটস আই’র) অসংখ্য মেয়ে-ভক্ত আছে। এতো এতো মেয়েভক্ত কী করে সামলান?
(হেসে..) মেয়ে ভক্ত আছে, ঠিক আছে। কিন্তু তাদের সামলানো অসম্ভব কিছু না। আমাকে আসলে তারা ফ্যান হিসেবে ফলো করে, কেউ বড় ভাই হিসেবে ট্রিট করে, আবার কেউ ফ্রেন্ড হিসেবে। ক্যাটস আই নিয়ে ভালো ভালো কম্পলিমেন্ট সব সময়ই আসে। অনেক সময় বিষয়টি অনেকেই নেতিবাচক হিসেবে দেখে। হতে পারে অনেকেই আমার চোখ দেখে ফ্যান হয়েছে অথবা খেলে দেখে। আমি চাইবো সামনেও তারা যেন আমাকে ফলো করে, আমার খেলা দেখে।
দলীয় শৃঙ্খলাটা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
আমার কাছে মনে হয় শৃঙ্খলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি গত তিনবছরে যতগুলো ম্যাচ খেলেছি, প্রিমিয়ার লিগ, বিসিএল, এনসিএলে যারা জুনিয়র আছে তাদের বলেছি আমাকে না হোক তারা যেন সিনিয়র যেমন মুশফিক ভাই, সাকিব ভাই কিংবা মাশরাফি ভাইকে ফলো করে। সেটা হলে তারা নিজেদের শতভাগ না হোক ৫০ ভাগ হলেও কিন্তু দিতে পারবে। হাতের কাছে যাকেই পাই ভালো খেলা ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের পরামর্শ দিই।
ক্রিকেটার সাব্বির নিজেকে কোন উচ্চতায় দেখতে চায়?
আমার লক্ষ্যটা অনেক বড়। এখনই বলতে পারছি না। তবে আস্তে আস্তে নিজের উন্নতি করতে চাচ্ছি, ভাল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চাইছি। ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা যেন আরও বড় করতে পারি সেটাই লক্ষ্য।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন আপনারা ধরেই নিয়েছেন জাতীয় দলে জায়গাটি আপনাদের জন্য পাকাপোক্ত। আপনাদেরে সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে ৬ জনকে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন পারফরম্যান্স ভালো না। উনি হয়তো ঠিক বলেছেন কিন্তু আগে তো আপনারা দেশকে দিয়েছেন। তারপরেও তার এমন মন্তব্য আপনাদের জন্য কতখানি কষ্টের?
কষ্ট পাইনি। কেননা আমি যদি পরিশ্রম করি অবশ্যই সামনে বড় একটি জায়গায় যেতে পারবো। আমি জাতীয় দলে খেলি না; খেলি প্রিমিয়ার লিগে। খেলি বা না খেলি সেটা বিষয় না। আমি যদি অনুশীলনে কষ্ট করি, শতভাগ দিতে পারি আমার বিশ্বাস এর প্রতিদান আমি পাবোই এবং আমার জায়গায় আবার ফিরে যাব।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৮
এইচএল/জেএম