তবে সামাজিক নানান কারণে প্রায় হোঁচট খেতে হচ্ছে তাকে। তারপরও গত ৬ মাসের অধিক সময় ধরে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে মীমের।
চলার পথটা মসৃণ না হলেও খেলাটা ধরে রাখতে চাওয়া মীম বাংলানিউজকে জানায়, বাবা মো. জাহাঙ্গীর আলম অসুস্থ, মা জাকিয়া বেগম বেসরকারি একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকুরি করেন। ৩ বোনের মধ্যে বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, মেঝো বোন অনার্সে পড়াশুনা করছে, আর সে পরিবারের সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলার প্রতি তার খুব আগ্রহ ছিল। এলাকার ভাইদের সঙ্গে খেলতো সে। যা দেখে কাকা সম্পর্কের এক ব্যক্তি তাকে ক্রিকেট কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। পরিবারের বর্তমান ৪ সদস্যের মধ্যে একমাত্র তার মা জাকিয়া বেগম-ই উপার্জন করেন। যার স্বল্প রোজগারে একইসঙ্গে পড়াশুনা করা ও ক্রিকেট খেলার অনুশীলন করাটা দুস্কর। তবে হাল না ছেড়ে বিগত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত স্টেডিয়ামে যাওয়া-আসা করছে।
যখন ক্রিকেটের জন্য কোচিং শুরু করে, তখন টাকার অভাবে বহুদিন পায়ে হেঁটেও ৩-৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে জানিয়ে মীম বলেন, মায়ের এক খালা সম্পর্কে নানু যার সহায়তায় এখন দিন কিছুটা ভালো যাচ্ছে। তবে পড়াশুনার খরচ মেটানোএখনও কষ্টকর। তারপরও একজন ভালো ক্রিকেটার হওয়ার লক্ষে খেলা এবং পড়াশুনা দুটোই চালিয়ে যেতে চায় মীম।
তার মতোই আনজানা ফারিন এশা, পড়াশুনা করছে বরিশালের নলছিটি উপজেলার জেডএ ভূট্টো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে। সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজের এই ফ্যান আরও ছোট থাকতেই ক্রিকেট খেলায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। যার সূত্র ধরেই বাকেরগঞ্জ উপজেলা সদরের খেজুরতলা এলাকার বাসিন্দা হয়েও প্রতিদিন প্রায় ১৫ কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিয়ে বরিশাল নগরের বান্দরোডস্থ শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত স্টেডিয়ামে যাওয়া আসা করছে। যেখানে বেসিক ক্রিকেট কোচিং একাডেমিতে সে নিয়মিত রপ্ত করছে ক্রিকেট খেলার প্রশিক্ষণ। এশারও ইচ্ছে রয়েছে ক্রিকেটার হিসেবে জাতীয় দলে বাংলাদেশের হয়ে খেলার।
এশার সঙ্গে প্রতিদিন তার মা অশ্রু খানম আসছেন, বসে থাকছেন প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডের পাশেই। তার চোখের সামনেই চলছে ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেয়ে এশার এগিয়ে চলার সংগ্রাম।
এশার মা অশ্রু খানম বলেন, সামাজিক নানান প্রতিকূলতার মধ্যে এর আগে এশা সাঁতার ও সাইকেল চালানো শিখেছে। এশার অদম্য ইচ্ছেতেই ক্রিকেট কোচিংয়ে ভর্তি করানো।
তিনি তার দুই মেয়েকে নিজের পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর জন্য কখনও কোন কাজেই বাধা হয়ে দাঁড়াননি জানিয়ে বলেন, সামাজিক নানান দিক চিন্তা করে প্রতিদিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সেই বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশালে আসছেন। এতে মা-মেয়ের যাতায়ত খরচ দ্বিগুন হলেও, যদি ভালো খেলে একটা পর্যায়ে যেতে পারে তখন মফস্বল শহরের বেড়ে ওঠা এই মেয়েই সকলের গর্বের কারণ হবে। আর এই কষ্টগুলোও থাকবে না তখন।
মফস্বল শহরে নারী ক্রিকেটারদের সঠিক পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি, সামাজিক ও পারিবারিক নানান প্রতিবন্ধকতা এখনও রয়েছে বলে জানিয়ে বরিশালের বেসিক ক্রিকেট কোচিং একাডেমি’র পরিচালক ও হেড কোচ এজাজা আল মাহমুদ সুজন বলেন, সবকিছুর পরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। খেলার মাঠে কখনও নারী-পুরুষ এই দুই বাক্যের ব্যবধান তুলে ধরা হয়না, তখন একটি শব্দই ব্যবহার হচ্ছে, তা হলো ক্রিকেটার বা খেলোয়াড়।
তিনি বলেন, কয়েকবছর আগেও মেয়ে ক্রিকেটার তেমন একটা পাওয়া যেতো না আমাদের এখানে। কিন্তু জেলা ক্রীড়া সংস্থার স্কুল পর্যায়ে খেলাধুলার একটি ক্যাম্পেইনের কারণে গত ৪/৫ বছর ধরে ক্রিকেটে মেয়েদের উপস্থিতি বাড়ছে। বরিশালে তো একজন নারী কোচই রয়েছেন যিনি তার একাডেমিতে শুধু মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এছাড়া আমার একাডেমিতেও প্রতি বছর মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। যেখানে এবারেও ৮ জনের মতো মেয়ে ক্রিকেটার রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ক্রিকেটে বরিশালের মেয়েরা বেশ ভালোও করছে। যেমন রাবেয়া খাতুন এরইমধ্যে বাংলাদেশের হয়ে এশিয়ান গেমস-এ খেলেছেন, নারী ওয়ার্ল্ড কাপেও বাংলাদেশ দলের হয়ে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছিলো তাকে। এছাড়া বর্তমানে অল্প দিনে মীম, রেশমা, আঁখিরাও ভালো করছেন।
তার মতে ক্রিকেটে যে সব মেয়েরা আসছে, তাদের মধ্যেই কেউ কেউ অনেক দরিদ্র পরিবারের রয়েছে। তাদের জন্য যতোটা সুযোগ করে দেয়া যায় তার চেষ্টা করছেন তারা। আর কঠোর পরিশ্রমে উন্নতি সাধন করার এ খেলায় মেয়ে খেলোয়াড়দের উপস্থিতি যতোই বাড়বে, ততোই নিরাপদ হবে পরিবেশ এবং শঙ্কা কমবে অভিভাবকদের।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘন্টা, মার্চ ০৮, ২০২০
এমএস/ইউবি