ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ মে ২০২৪, ০০ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

অবৈতনিক প্রশিক্ষণে চিকিৎসক শোষণ

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০২২
অবৈতনিক প্রশিক্ষণে চিকিৎসক শোষণ ...

চট্টগ্রাম: সরকারি হাসপাতালে সকাল ৮টার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের দেখা মিললেও বাকিটা সময় চিকিৎসার জন্য নির্ভর করতে হয় ইন্টার্ন ও অবৈতনিক হিসেবে দায়িত্বরতদের ওপর। মূলত তারাই সচল রাখেন সব কার্যক্রম।

জানা গেছে, এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা এক বছরের জন্য হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। পুরো সময়ে মেডিসিন, সার্জারি ও গাইনি- এই তিনটি বিষয় ধরে সময় ভাগ করা হয়।

একজন শিক্ষার্থী ঠিকমতো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কি না, তা লগ বইয়ে লিখে রাখেন সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষক। এসময় ইন্টার্নরা পর্যায়ক্রমে ২৪ ঘণ্টা রোগীর চিকিৎসা সেবা দেন। বিনিময়ে মাসে ভাতা দেওয়া হয় ১৫ হাজার টাকা। প্রয়োজনের তুলনায় এ টাকা কম হওয়ায় তাদের যুক্ত হতে হয় টিউশনি বা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে।

অপরদিকে এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাদের ভাতাও বন্ধ হয়ে যায়। পরে যাদের অধিক দক্ষতা অর্জনের জন্য পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং (পিজিটি) করতে হয়, তাদের অবৈতনিক হিসেবেই দেওয়া হয় নিয়োগ। প্রথম ৬ মাস প্রশিক্ষণের পর আরও দক্ষতা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত অনেক চিকিৎসককে এ কাজে লেগে থাকতে হয়। কিন্তু অবৈতনিক বিধায় তারা পান না কোনও প্রকার ভাতা। কাজের চাপে নেওয়া যায় না বিসিএস এর প্রস্তুতি।

প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী চিকিৎসকরা জানান, অবৈতনিক প্রশিক্ষণের জন্য যেসব বেসরকারি চিকিৎসক নির্বাচিত হন, তারা রোগীর ইনজুরি সার্টিফিকেট দিতে পারেন না, সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে অন্য কোথাও চাকরি করা তাদের জন্য নিষিদ্ধ। পাশাপাশি থাকে না বাসস্থানের সুযোগ, দেওয়া হয় না যাতায়াত খরচ। কোনও প্রশিক্ষণার্থী ১৫ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে সেই সেশনের জন্য তার প্রশিক্ষণও বাতিল হয়ে যায়।  

জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরাও (অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, রেজিস্ট্রার) স্বীকার করছেন, অবৈতনিক প্রশিক্ষণার্থীরা হাসপাতালে গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী তাদের সুযোগ-সুবিধা নেই। শুধুমাত্র ইন্টার্ন করার সময়কার ঘাটতি মেটাতেই তাদের এই প্রশিক্ষণ নিতে হয়।

এমবিবিএস এবং বিডিএস পাস করা বেসরকারি চিকিৎসকদের জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে জানুয়ারি-২০২৩ ব্যাচে অবৈতনিক স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণের আবেদনপত্র দেওয়া শুরু হচ্ছে ৪ ডিসেম্বর থেকে। এরপর ২২ ডিসেম্বর হবে নিজ নিজ বিভাগে সাক্ষাৎকার। ২৭ ডিসেম্বর দেওয়া হবে ফলাফল।

এই প্রতিষ্ঠানের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এস এম নোমান খালেদ চৌধুরীর মতে, ‘কোনও ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই অনারারী ট্রেনিং এর নামে নতুন পাস করা চিকিৎসকদের মানসিকভাবে শোষণ করার নিয়ম চলে আসছে বছরের পর বছর। এই অনারারী প্রশিক্ষণার্থীদের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারি চিকিৎসকদের মতো। কিন্তু তাদের কোনও টাকা দেওয়া হবে না। স্রেফ শ্রম শোষণ। আবার এই চিকিৎসকরা কোথাও চাকরিও করতে পারবে না। তারা জীবনধারণ কিভাবে করবে? পৃথিবীর কোথাও কোনও সেক্টরে এই শোষণ ব্যবস্থা নেই। আমাদের রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশের অর্থনীতি অনেক বড় হয়েছে এবং জনকল্যাণে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বহুমাত্রিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এদের বেলায় নেই। আমি এই অনারারী প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়ে গ্রহণযোগ্য মাত্রার ভাতা প্রদানের অনুরোধ করছি। এই চিকিৎসকদের জীবন ও জীবিকার দরকার আছে এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে’।

জামান অ্যালেক্স নামের এক চিকিৎসক বলেন, ২০১৩ সালে অনারারী মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে মেডিসিন বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে বলা হতো ‘অনাহারী মেডিক্যাল অফিসার’। নামটা যুতসই, যে ব্যক্তির মাথায় প্রথমে এই শব্দটা এসেছিলো, তার তাচ্ছিল্য ও রসবোধের প্রশংসা করতে হয়। ডে-অফ বলে কোনও বিষয়ের বালাই নেই। অঘোষিত ‘মার্শাল ল’ সিস্টেমের ভিতর দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যেতে হয় একেবারে বিনাপয়সায়।  

‘এই যে অনারারী প্রথা এখনও চলছে, আমি জানি না- এই অযৌক্তিক বর্বর প্রথা কবে, কে শুরু করেছিলেন। আপনি কি কখনও চিন্তা করতে পারেন, একটা অশিক্ষিত লোককে ৭ দিন খাটাবেন, অথচ একটা পয়সাও দিবেন না; কোনও সভ্য সমাজ এর স্বীকৃতি দিবে? প্রশ্নই আসে না। তবে কোন যুক্তিতে একজন উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসককে বিনা পয়সায় খাটাবেন? অনারারী ট্রেইনি ও রেসিডেন্সীদের ভাতা দিতে হবে। সব সভ্য দেশই দেয়, বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। যেসব নবীন চিকিৎসকদের ব্যবহার করে তাদের রক্ত পানি করে জনগণকে বিনাপয়সায় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে, তাদের দিকে কি সরকার সহানুভূতির হাত প্রসারিত করতে পারে না’? 

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. অং সুই প্রু মারমা জানান, অবৈতনিক স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীতদের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে নির্দিষ্ট শর্তাবলী মেনে চলতে হয়। সব প্রতিষ্ঠানেই এই নিয়ম চলে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় জানুয়ারি-২০২৩ ব্যাচে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগের নিমিত্তে আবেদনপত্র আহ্বান করা হচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০২২
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।