ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ পৌষ ১৪৩১, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘মুজিব সরকার এবং হাসিনা সরকার, দুজনেই দুর্নীতির কারণে পরাস্ত হয়েছে'

ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪
‘মুজিব সরকার এবং হাসিনা সরকার, দুজনেই দুর্নীতির কারণে পরাস্ত হয়েছে' ...

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: মুজিব সরকার এবং হাসিনা সরকার, দুজনেরই দুর্নীতির কারণে পরাস্ত হয়েছে। মুজিব সরকারের দুর্নীতির অনেক উদাহরণ আমরা জানি।

৯৩ হাজার সেনাবাহিনী নিয়ে অরোরার কাছে নিয়াজির আত্মসমর্পণ। কেন সেদিন এমএজি ওসমানীকে রাখা হয়নি? সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীকে এভাবেই স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।

সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) বিজয় দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আয়োজিত "বর্তমান বাংলাদেশে বিজয় দিবসের তাৎপর্য" শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) সকাল ১১টায় সমাজবিজ্ঞান অনুষদ মিলনায়তনে আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকাল ১০টায় স্বাধীনতা স্মারস ভাস্কর্যে পুষ্পাস্তবক অর্পণ শেষে একটি আনন্দ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রক্টর অধ্যাপক ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন।  

জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান বলেন, যে ন্যারেটিভ একাত্তর পরবর্তীতে তৈরি করা হয়েছিলো। সেটা ভাঙ্গার জন্যই আজকের এই গণঅভ্যুত্থান। আমাদের ছাত্ররা শিখিয়েছে কিভাবে এই ন্যারেটিভ ভাঙতে হয়। আমাদের দুঃখ হলো চব্বিশ পরবর্তী কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। যাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন স্বাধীনতা পরবর্তীতে উপদেষ্টা হয়েছি, তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে এখন।

তিনি আরও ৪ আগস্ট আমার তিন সন্তান আর আমি গুলির মুখে পড়েছিলাম। তখন ভেবেছিলাম আমরা আর ফিরবো না। এরপর যখন ফিরে আসি, তখন শুনি সেই রাতে আমার বাসায় আবার হামলা হতে পারে। সেই রাতে আমরা অন্যের বাসায় চলে গেলাম। আমাদের জন্য আরেকটা আয়নাঘর প্রস্তুত ছিলো। আমি সবসময় জনতার কাতারে থাকতে চাই। আবার যদি বৈষম্যের কারণে জনতার মিছিলে যুক্ত হতে হয় আমরা প্রস্তুত আছি।  
 
ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এসএম নসরুল কদির বলেন, বিজয় যে নবায়ন করতে হয়, সেটা আমরা কখনো শুনিনি। কিন্তু রব্বুল আলামিন আমাদের দেখিয়েছেন, বিজয় অর্জনের পর ঘুমিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। স্বাধীনতা অর্জনের পর একটা পক্ষ এটা নিজেদের বলে দাবি করেছিলো। তাদের হাত ধরেই আবার লুটপাট, ভাগাভাগি, হরিলুট রাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব জায়গায় হয়েছে। অনেক কাজ করতে গিয়ে দেখি এমনও বাজেট হয়েছে যার অর্ধেক দিয়েও কাজ হয়ে যেতো। আমরা আশাকরি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আগামী দিনে দুর্নীতিমুক্তি একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে।  

উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, এ দেশের সব আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। পাকিস্তান অত্যন্ত কৌশলে আমাদের অধিকার হরণ করেছিলো। আর এ জন্যই স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিলো। পশ্চিমাদের খুশি করতে গিয়ে স্বাধীনতার পর আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় আঘাত করা হয়েছিলো এদেশের ইতিহাসের ওপর। স্বাধীনতার ঘোষকের নাম মুছে ফেলা হয়েছিলো। ইসলামী মূল্যবোধকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। যেই দল মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিলো, সেই দলকেও স্বৈরশাসক নিষিদ্ধ করার দুঃসাহস করেছে। পাকিস্তানি আমলেও এভাবে পুলিশকে লেলিয়ে দিয়ে মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়নি। তখন কোনো আয়নাঘরও ছিলো না। কিন্তু আমরা দেখেছি ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সব হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস লিখতে গিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ১৩৩ দিন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। র‍্যাব গিয়ে আমাদের দরজায় ঠকঠক করে বলেছে, 'আপনার কিন্তু দুজন কন্যা আছে ভুলে যাবেন না'। চব্বিশের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা শিক্ষার্থীদের ফ্যাসিবাদের মতো শুধুমাত্র আশ্বাসে আটকে রাখতে চাই না। আমরা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিচ্ছি তাদের সব যৌক্তিক দাবি পূরণ করা হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, দেশ স্বাধীন করলাম আমরা আপামর জনতা। সেখানে আমরা দেখি, ৯৩ হাজার সেনাবাহিনী নিয়ে অরোরার সঙ্গে নিয়াজির আত্মসমর্পণ। কেন সেদিন এমএজি ওসমানীকে রাখা হয়নি? এই একটি প্রশ্নের উত্তর আমি সারাজীবন পাইনি। আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি উসমানীকে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। কেন তিনি অজ্ঞাত, কেন তিনি অখ্যাত এর ইতিহাস আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।  

এসময় তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী কোনো গবেষণাই মনে করে না যে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছে। বরং সর্বোচ্চ ৮০-৮৫ হাজার শহীদের একটা সংখ্যা পাওয়া যায়। আমি বর্তমান সরকারের প্রতি, বিশেষ করে প্রফেসর ড. ইউনুসের সরকারের প্রতি দাবি জানাই, আমাদের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা, তাদের ঐতিহাসিক তালিকা করতে হবে।  এবং বাংলাদেশের অঞ্চলে অঞ্চলে তাদের নাম খোদাই করে লিখে রাখতে হবে। পাশাপাশি যারা রাজাকার ছিল তাদেরও তালিকা আমরা চাই। মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকার উভয়ের তালিকাই জাতির সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন।

অধ্যাপক শামীম বলেন, ড. আতিউর রহমান গভর্নর হওয়ার পর সবাই খুশি হয়েছিলেন। অথচ তার সময়ে ১০১ মিলিয়ন ডলার এদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। এ ধরনের শিক্ষকদের কারণে আমার দেশের অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থা। অন্যথায় আমরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ একটি দেশে পরিণত হতাম।

চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, যে ঐক্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম সে ঐক্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। ঐক্য কুক্ষিগত করেছে একটা দল, যে দলটা পরাস্ত হলো। মুজিব সরকার এবং হাসিনা সরকার, দুই জায়গায়ই দুর্নীতির কারণে পরাস্ত হয়েছে। মুজিব সরকারের দুর্নীতির অনেক উদাহরণ আমি জানি।

এসময় তিনি আরো বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনটা আমাদের বাংলাদেশের সামনে একটা অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। ১৯৭১ সালে একবার উপহার দিয়েছিলো আমরা সেটাকে ভূলন্ঠিত করেছি। এখন আবার নতুন বাংলাদেশে আবার একটি অভূতপূর্ব সংস্কারের সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ যদি আমরা হাতছাড়া করি তাহলে আবার আয়নাঘরের সৃষ্টি হতে পারে। কজেই এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।  

চবি উপাচার্য বলেন, এই সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে এই পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি এই সরকার। অথচ সরকারের সর্বপ্রথম উচিত ছিলো শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া। কারণ যতো ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ অফিসার, আর্মি অফিসার, বিসিএস ক্যাডারসহ যা কিছু আছে সব কিন্তু এই শিক্ষাক্ষেত্র থেকেই বের হয়৷ কাজেই এই শিক্ষাক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় সংস্কার প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে বলেই আজকে আমরা অনেক বিষয় জানতে পারছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ভারতের আধিপত্য এবং দাদাগরি এখনও চলছে। তাই আমাদের সতর্ক হতে হবে। ফ্যাসিবাদি সরকার তাদের সহযোগীতায় আমাদের স্বাধীনতা হরণ করেছে। শিক্ষার্থীরা আমাদের যেই স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তাকে রক্ষা করতে হলে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি বন্ধ করতে হবে।  

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. এনায়েত উল্লা পাটওয়ারী, ছাত্র-ছাত্রী পরামর্শ ও নির্দেশনা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. আনোয়ার হোসেন, বিভিন্ন হলের প্রভোস্ট, বিভাগের সভাপতি, অফিসার সমিতি, কর্মচারী সমিতি, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪
এমএ/পিডি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।