ঢাকা, রবিবার, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২, ২৯ জুন ২০২৫, ০৩ মহররম ১৪৪৭

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সাড়ে ৩ হাজার গরুর খামার বদলে দিয়েছে শহর-গ্রামের চিত্র

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:১০, মে ২৪, ২০২৫
সাড়ে ৩ হাজার গরুর খামার বদলে দিয়েছে শহর-গ্রামের চিত্র ...

চট্টগ্রাম: নগর ও গ্রামে বড় পরিসরে গড়ে ওঠা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গরুর খামার থেকে প্রতি বছর মিটছে কোরবানির পশুর চাহিদা। এসব খামারে দেশিয় ও বিদেশি জাতের গরু লালন-পালন করা হচ্ছে।

উচ্চবিত্ত পরিবার ও প্রবাসীরা পশুর হাটের চেয়ে খামারে গিয়ে গরু কিনতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।  

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলা এবং নগরের ৩ থানায় এবছর কোরবানির চাহিদা প্রায় ৮ লাখ ৯৬ হাজার ২৬৯টি পশু।

এর মধ্যে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর উৎপাদন বা প্রাপ্যতা ৮ লাখ ৬০ হাজার ৮৮২টি। কোরবানির জন্য ষাঁড়ের সংখ্যা ৩ লাখ ৬৫ হাজার ২৯টি, বলদ ১ লাখ ২১ হাজার ৬৭০টি, গাভি ৪৯ হাজার ১১৪টি এবং মহিষ ৬৪ হাজার ১৬৩টি প্রস্তুত রয়েছে। এর বাইরে দুই লাখ ৫ হাজার ১৭৪টি ছাগল, ৫৫ হাজার ৬৯৭টি ভেড়া ও অন্যান্য পশু আছে ৩৫টি।

শুধু নগরেই এখন দেড় শতাধিক এগ্রো খামার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ৫০-৬০টি বড় খামারে হাজারখানেক গরু পালন করা হচ্ছে। শিক্ষিত তরুণরা এসব খামার দেখভাল করছেন। টিকে গ্রুপ, আরডিএম গ্রুপ, ওয়েল গ্রুপ, শেঠ গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, এশিয়ান গ্রুপ, শাহ আমানত গ্রুপ, চৌধুরী গ্রুপ, কন্টিনেন্টাল গ্রুপের মতো বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এগ্রো খাতে টাকা বিনিয়োগ করে কোরবানির মৌসুমে লাভবান হচ্ছে। দুই লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা দামের গরু বিক্রি হচ্ছে এসব খামারে।  

২০২০ সালে নাসিরাবাদে ৩০ কাঠা জমিতে গড়ে ওঠা ইউনি এগ্রো ফার্মে মিলছে চাহিদামতো কোরবানির গরু। আরডিএম গ্রুপের চেয়ারম্যান রাকিবুল আলম চৌধুরী এই ফার্মের উদ্যোক্তা। খামারে এখন আড়াই লাখ টাকা থেকে ১১ লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে। এশিয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ ছালামের ছেলে ওয়াসিফ আহমেদ ২০১৬ সালে ৪টি গরু নিয়ে শুরু করেন এশিয়ান অ্যাগ্রো খামার। সেই খামারে এখন শতাধিক কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। মোহরায় ওয়েল এগ্রো খামারেও আছে দুই শতাধিক কোরবানির গরু। টিকে গ্রুপের পরিচালক হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা মার্শালের টিকে এগ্রো খামারে শাহিওয়াল, ফ্রিজিয়ান ও ক্রস ফ্রিজিয়ান কোরবানির গরু রয়েছে।  

শাহ আমানত অ্যাগ্রোর স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ হোসেন জ্যাকি পারিবারিক ব্যবসার বাইরে শখের বশে খামার শুরু করেছিলেন। বর্তমানে তার খামারে ১০০টি গরু রয়েছে। কন্টিনেন্টাল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলিফ চৌধুরী ২০১৮ সালে ৬০টি গরু দিয়ে সারা অ্যাগ্রো ফার্মের যাত্রা শুরু করেন। ব্রিডিংয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে গত কোরবানির মৌসুমে এই খামার থেকে ২৫০টি গরুর বেশিরভাগ বিক্রি হয়ে যায়। একটি প্রজনন খামারসহ দুটি খামারে প্রায় ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। ব্যবসায়ী তানভীর কালাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে ২০২১ সালে কর্ণফুলী উপজেলায় ২১টি গরু নিয়ে ওজি অ্যাগ্রো খামার শুরু করেন। বিনিয়োগ করেন প্রায় ৫ কোটি টাকা। বর্তমানে তার খামারে শ’খানেক গরু রয়েছে। এই খামার থেকে প্রতিদিন আসে ২৫০ লিটার দুধ।

নাহার এগ্রো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুর রহমান টুটুলের মা সামসুন নাহারের নামে প্রতিষ্ঠিত নাহার এগ্রো গ্রুপের অধীনে পোল্ট্রি, ডেইরি, ফিড মিলসহ নানান খাতে রয়েছে ১০টি কোম্পানি। ১৯৯১ সালে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ও ৮৭ হাজার টাকায় ২টি দুগ্ধজাত গরু কিনেন টুটুল। আশপাশের এলাকায় বিক্রি করা হতো দুধ। চাহিদা বাড়ায় পরের বছর ১ লাখ ৪১ হাজার আরও একটি গরু কেনা হয়। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বাছুর সহ ১৭টি গরু হয় খামারে। পিতা মাহবুবুর রহমানের মৃত্যুর পর মাস্টার্সে পড়ার সময় গরু নিজেরা লালন-পালন করতেন। কিছু গরু বিক্রি করতেন। ডেইরি ফার্ম থেকে প্রতিদিন প্রায় ২শ লিটার দুধ পাওয়া যেতো। ১৯৯৪ সালে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ডেইরি ফার্মে বাড়াতে থাকেন গরুর সংখ্যা। ২০০২ সালে নাহার এগ্রো কমপ্লেক্স লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়। এরপর মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে কারখানা। বর্তমানে তাদের ফার্মে পর্যাপ্ত গরু রয়েছে কোরবানির উপযোগী।

চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় ৩৫ হাজার ছোট খামার গড়ে উঠেছে। ২ থেকে ১০টি করে গরু নিজ বাড়িতে লালন-পালন করেন গৃহস্থরা। যারা সচ্ছল, তারা শেডের ভেতর দুই সারিতে গরু রাখেন। গরম থেকে স্বস্তি দিতে কেউ বসান বৈদ্যুতিক পাখা। বিদ্যুৎ চলে গেলে থাকে জেনারেটরের ব্যবস্থাও। পরিচর্যায় পালাক্রমে থাকে মানুষ। নিয়মিত গোসল করানোর পাশাপাশি খাওয়ানো হয় প্রাকৃতিক খাবার। কোরবানির ঈদে এসব গরু বাজারে বিক্রি করে লাভবান হন তারা।  

এবারের কোরবানিতে বোয়ালখালী উপজেলায় পশুর চাহিদা রয়েছে ২৯ হাজার ৭৪২টি, সাতকানিয়ায় ৪৫ হাজার ৩৭১টি, চন্দনাইশে ৪৭ হাজার ৪টি, আনোয়ারায় ৬৩ হাজার ৪২৮টি, পটিয়ায় ৭০ হাজার ১৮০টি, কর্ণফুলীতে ৩৩ হাজার ৫৩৩টি, মীরসরাইয়ে ৫৮ হাজার ৭৮০টি, সীতাকুণ্ডে ৫৬ হাজার ৮৫০টি, হাটহাজারীতে ৪৪ হাজার ৮৯০টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৫০ হাজার, ফটিকছড়িতে ৬৯ হাজার ৪১৯টি, লোহাগাড়ায় ৩৮ হাজার ৫৯টি, রাউজানে ৩৪ হাজার ৩০২টি, বাঁশখালীতে ৫৯ হাজার ৪০৪টি।

উদ্যোক্তারা বলছেন, শহর-গ্রামে খামার করে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। শিক্ষিত যুবকরা চাকরির আশায় না ঘুরে নিজেরা খামার গড়ে শ্রম দিচ্ছেন। গরুর খামারিরা সামাজিক মাধ্যমে বিক্রয়যোগ্য গরুর ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য তথ্য দিচ্ছেন। তা দেখে ক্রেতারা অনলাইনেই পছন্দমতো গরু খুঁজে নিচ্ছেন। দামে বনিবনা হলে ক্রেতার কাছে অনেকে ট্রাকে করে গরু পৌঁছে দিচ্ছেন। খামার মালিক ও ক্রেতা উভয়েই এই ব্যবস্থাপনায় খুশি। এতে থাকছে না হাটে গিয়ে গরু কেনার দুর্ভোগ।

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি নানা উদ্যোগ, প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে গৃহস্থ পর্যায়ে গবাদি পশুর লালন-পালন, খামার, উৎপাদন বাড়ছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য এখন অনেক উচ্চশিক্ষিত তরুণ খামারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। তারা আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থায় গরু লালন-পালন করে লাভবান হচ্ছেন।

এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।