ঢাকা, শুক্রবার, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৬ জুন ২০২৫, ০৯ জিলহজ ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘টোকাই’ না থাকলে প্লাস্টিক বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হতো চট্টগ্রাম

মুহাম্মাদ আজহার, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৩১, জুন ৫, ২০২৫
‘টোকাই’ না থাকলে প্লাস্টিক বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হতো চট্টগ্রাম ...

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: যাদের বেশিরভাগ সময় কাটে ময়লার ভাগাড়ে, সমাজে যাদের নামকরণ হয়েছে ‘টোকাই’ নামে, সেই অবহেলিত শিশু-কিশোররাই যে চট্টগ্রাম নগরকে বসবাস উপযোগী রাখতে কত বড় ভূমিকা রাখছে নিজের অজান্তে, তা কেবল একটি সমীকরণ দেখলেই উপলব্ধি করা যায়।

গবেষণায় উঠে এসেছে চট্টগ্রামের বর্জ্য সংক্রান্ত এমন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত।

গবেষকদের মতে, চট্টগ্রাম নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে ৫০ লাখের বেশি বাসিন্দা বছরে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৩ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে। অপরদিকে ২০ হাজার ৫০২ জন শ্রমিক ও উদ্যোক্তা প্রতি বছর ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৯ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ এবং রিসাইক্লিং বা পুনঃব্যবহার করে নানাবিধ পণ্য তৈরিতে অবদান রাখছেন।
যা মোট উৎপাদিত বর্জ্যের প্রায়ই ৭৩ শতাংশ। আর এ কাজে সুবিধাবঞ্চিত টোকাই পথশিশুদের রয়েছে বড় অবদান। অন্যথায় চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা যেমন কয়েকগুণ বেড়ে যেতো, তেমনি চট্টগ্রাম শহর পরিণত হতো ময়লার ভাগাড়ে।

লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি নিজের অজান্তেই নগরবাসির কষ্ট লাঘব করছে টোকাইরা। তবে গবেষকদের মতে, ময়লা সংগ্রাহকরা সচেতনতার অভাবে অনেক বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করে থাকে। তাই প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনার পাশাপাশি ভাঙারি, টোকাই এবং সিটি করপোরেশনের ময়লা সংগ্রাহকদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষক। এ প্রকল্পের আওতায় এরইমধ্যে বিনামূল্যে পিপিই, হ্যান্ডগ্লাভস, মাস্ক ও বুট জুতা বিতরণ করেছে তারা।  

বিশ্ব ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘প্লাস্টিক ফ্রী রিভারস অ্যান্ড সিজ ফর সাউথ এশিয়া (প্লিজ)’ প্রকল্পের আওতায় ‘ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসেজ (ইউএনওপিএস)’ ও ‘সাউথ এশিয়া কো-অপারেটিভ এনভায়রনমেন্ট পোগ্রাম (এসএসিএপ)’ এর তত্ত্বাবধানে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে চবির সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের নেতৃত্বে এ গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়।

৮ সদস্যের এই গবেষক দলে রয়েছেন- চবির মেরিন সাইন্সেস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আলাউদ্দিন মজুমদার, মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর, মেরিন সাইন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এসএম শরিফুজ্জামান, অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন, সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শাহ নেওয়াজ চৌধুরী, প্রভাষক ইশতিয়াক আহমাদ চৌধুরী এবং নাইনা ইসলাম। এছাড়াও মেরিন সাইন্সেস ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা এই গবেষণায় সহযোগী হিসেবে ছিলেন।

গত ৬ মে নগরের কাজীর দেউড়ীর হোটেল রেডিসন ব্লু’তে ‘মাল্টি স্টেকহোল্ডার কনসাল্টেশন ওয়ার্কশপ অন প্লাস্টিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ইন চিটাগং সিটি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে গবেষকরা তাদের এসব কার্যক্রম তুলে ধরেন। বৃহস্পতিবার (৫ জুন) বিশ্ব পরিবেশ দিবসে গবেষণা কার্যক্রমটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

গবেষক দলের সদস্য মেরিন সায়েন্সেস ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহ নেওয়াজ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ ১০ মাস কাজ করে চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য সংক্রান্ত তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছি। প্রতিটি শহরেই এমন গবেষণা হওয়া উচিৎ, যাতে সঠিক পরিকল্পনা করা যায়’।

তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা অনেক প্লাস্টিক তৈরি করে ফেলেছি, যা কখনোই পরিবেশ থেকে বিলুপ্ত করা যাবে না। পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে তৈরি করে ফেলা এসব প্লাস্টিককে বারবার ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। ভাঙাড়িরা জানে না, কোন কোন প্লাস্টিক রিসাইকেল করা যায়। তাই তারা পাইকার ব্যবসায়ীদের কাছে ভালো দামও পায় না। আমরা বিষয়গুলো তাদের শেখানোর মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইক্লিংয়ে উৎসাহিত করেছি। এভাবে প্লাস্টিককে পুনরায় ব্যবহার করলে পরিবেশের ওপর যে চাপ, তা থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যাবে’।

গবেষক দলটি শিক্ষার্থী এবং উদ্যোক্তাদের কাজে লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব কলম, সুপারি পাতার তৈরি বিভিন্ন ধরনের বাটি, চামচ ও নানা উপকরণ, ফুডগ্রেড কাগজের তৈরি কাপ ইত্যাদি তৈরি করে দেখিয়েছেন। পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদী নানান পরিকল্পনাও উঠে এসেছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন সুপারশপ, ফুডকোর্ট, ট্যুরিস্ট এলাকার খাবারের দোকানগুলোতে প্রায় ২০ হাজার সেট পরিবেশবান্ধব কাটলারী বিতরণ করেছেন গবেষকরা।

গবেষক দলে নেতৃত্ব দেওয়া চবির মেরিন সাইন্সেস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘প্লাস্টিক দূষণ রোধে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্কুলে গত ১০ মাস নানান আয়োজন করেছি আমরা। এতে বিভিন্ন স্কুলের ২ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীকে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়। যেখানে প্লাস্টিক মুক্ত স্কুল গড়তে শিক্ষার্থীরা ‘অডিট বিন প্রোগ্রাম ও লিটার কালেকশন’ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে এর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে চিত্রাংকনের মাধ্যমে নতুন ধারণা তৈরিসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন আমাদের গবেষক টিম’।

তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম শহরের প্লাস্টিক বর্জ্যের উৎস, ধরন, পরিমাণের তথ্য সংকলনের পাশাপাশি সঠিক ব্যবস্থাপনায় প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও পুনঃব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ, বিকল্প পণ্য তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্প পণ্যের ব্যবহার, বিভিন্ন স্কুলে সচেতনতামূলক সেমিনারসহ প্লাস্টিকের চক্রাকার অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় উদ্বুদ্ধ করতে নেওয়া হয়েছে নানান উদ্যোগ। যা দীর্ঘমেয়াদে নদী ও সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ রোধে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি প্লাস্টিকের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এসব পণ্য বিক্রি করে তারা যেমন স্বাবলম্বী হবেন, তেমনি রক্ষা করবেন প্রকৃতিকেও’।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দলটি ভয়াবহ দূষণ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় কাজ করছেন। প্লাস্টিক জালের দূষণ সম্পর্কে তারা যেমন জেলেদের সচেতন করছেন, তেমনি পরিত্যক্ত জাল থেকে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির মাধ্যমে বর্জ্যকে রূপান্তর করছেন বাণিজ্যিক সম্ভাবনায়।

এমএ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।