ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘মারে অ্যাঁই কী জওয়াব দিয়ূম’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩
‘মারে অ্যাঁই কী জওয়াব দিয়ূম’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: ‘অ্যাঁর ভাই অ্যাঁরে ফেলাই কনদিন ভাত ন হা। অ্যাঁই কেনে ভাইয়রে ফেলাই ভাত খাইয়ূম।

অ ভাই, অ্যাঁরে বদ্দা কনে ডাইবু ? অ্যাঁর মারে অ্যাঁই কী জওয়াব দিয়ূম ? (আমার ভাই আমাকে ফেলে কোনদিন ভাত খায়নি। আমি কিভাবে ভাইকে ফেলে ভাত খাব।
ও ভাই, আমাকে বড় ভাই কে ডাকবে ? মাকে আমি কী জবাব দেব ?)

বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর হলি ক্রিসেণ্ট হাসপাতালে ছোট ভাই যুবলীগ কর্মী আব্দুল জব্বারের (২৬) লাশের পাশে দাঁড়িয়ে এভাবেই বিলাপ করছিল আব্দুল মান্নান। কাঁদতে কাঁদতে জামায়াত-শিবিরের নৃশংসতা আর পুলিশের দায়িত্বহীনতার বর্ণনাও দেন মান্নান।

১০ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লা ওরফে কসাই কাদেরের ফাঁসির সব আয়োজন শেষ হয়েও আইনি জটিলতায় ওইদিন ফাঁসি হয়নি। একদিকে যখন চলছিল যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির আয়োজন, অন্যদিকে তার দোসরদের ঘাঁটি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় চলছিল জামায়াত-শিবিরের নিমর্ম বর্বরতা।

ফাঁসি না হলেও ওইদিন রাত ১২টার দিকে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া ইউনিয়নের মাদারবাড়ি গ্রামে যুবলীগ কর্মী আব্দুল জব্বারের বাড়িতে হামলা করে। তারা পাকা ঘরের লোহার গ্রিল কেটে ঢুকে জব্বারকে  নৃশংসভাবে মাথায় আঘাত করে ও কুপিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। সেই জব্বার টানা ৯দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।

আব্দুল মান্নান ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‍রাত ১২টার দিকে হঠাৎ দেখি ২০০-২৫০ জামায়াত-শিবিরের লোক চিৎকার করতে করতে আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। তারা প্রথমে বাড়িতে আগুন দেয়ার চেষ্টা করে। পরে লোহার গ্রিল কেটে ভেতরে ঢুকে আমার ভাইকে কোপাতে থাকে। আমার মা-বাবা বাঁচাতে গেলে তাদেরও মারধর করে।

তিনি জানান, জামায়াত-শিবিরের একদল নেতাকর্মী জব্বারকে কুপিয়ে উল্লাস করছিল, আরেক দল পুরো ঘরে লাইট, ফ্যান, খাট, আলমিরাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছিল। বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র এসময় তারা লুট করে নিয়ে যায়।

ঘরের মধ্যে যখন জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব চলছিল তখন মান্নান কোনমতে নিজেকে প্রাণে বাঁচিয়ে গ্রামের মধ্যে লোকজনকে ডাকতে যান। কিন্তু কেউই তার ডাকে সাড়া দেয়নি। তাদের রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি।

জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবকারীরা চলে যাবার পর আহত ভাইকে নিয়ে রাতভর এলাকায় ডাক্তারের কাছে ছুটোছুটির পর ১১ ডিসেম্বর ভোরে নিয়ে আসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ার পর বুধবার বিকেল ৪টার দিকে তাকে হলিক্রিসেণ্ট হাসপাতালে নেয়া হয়।

পুলিশের জবাব, প্রধানমন্ত্রীরে বলেন
আব্দুল মান্নান অভিযোগ করেন, তাদের বাড়িতে যখন জামায়াত-শিবির হামলা চালায় তখন তিনি ‍পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাননি। বরং সাতকানিয়া সার্কেলের এএসপি একেএম এমরান ভূঁইয়া, ওসি আব্দুল লতিফ, এএসআই আবু জামাল তার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেন।

তিনি জানান, এলাকার লোকজন যখন তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি তখন মান্নান সাতকানিয়া রাস্তার মাথা এলাকায় পুলিশ দেখে তাদের কাছে যান। এসময় সেখানে কর্তব্যরত ছিলেন জেলা পুলিশের এএসআই আবু জামাল। মান্নান তাদের বাড়িতে যাবার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীরে বলেন, উনারে ফোন দেন। উনি যেন এসে জামায়াত-শিবিরের হাত থেকে আপনাদের রক্ষা করেন।

সাতকানিয়ার কেরাণিহাট এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন এএসপি একেএম এমরান ভূঁইয়া। তাকে অনুরোধ করার পর তিনি আব্দুল মান্নানকে ধমক দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেন। আর ওসি আব্দুল লতিফকে ফোন দিলে তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন।

ক্লিনিকে যুবলীগ আব্দুল জব্বারের লাশ দেখতে এসে একই অভিযোগ করে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানও। তিনি বলেন, সাতকানিয়ায় ১২০ জনের মত পুলিশ আছে। এদের মধ্যে ৫০ জন নিয়ে এএসপি রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকেন আর ৭০ জন নিয়ে ওসি থানায় বসে থাকেন। কেউ জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের কাছে আক্রান্ত হয়ে সাহায্যের জন্য গেলেও তারা কোথাও মুভ করেন না। আর সুযোগ পেলে নিরীহ মানুষ ধরে হয়রানি করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য সাতকানিয়া সার্কেলের এএসপি একেএম এমরান ভূঁইয়ার মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এদিকে যুবলীগ কর্মী আব্দুল জব্বারের মৃত্যুর খবর পেয়ে ক্লিনিকে ছুটে যান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ এবং সাতকানিয়া থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভিও।

মোছলেম উদ্দিন উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াত-শিবির পরিকল্পিতভাবে সাতকানিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেছে বেছে হামলা করছে, তাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে। কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ায় জামায়াত-শিবির এখন প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।

আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভি বলেন, মানুষের বাড়িঘরে হামলা করা, মানুষকে খুন করা ইসলাম ধর্ম সমর্থন করেনা। এর নাম ধর্ম নয়। ইসলামের সবসময় শান্তির কথা বলে। ধর্মের নামে কেউ বিপথে থাকলে তাদের সুপথে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

আব্দুল মান্নান জানায়, তার বাবা লাল মিয়া বান্দরবানে গণপূর্ত বিভাগের গাড়িচালক। তারা দু’ভাই, দু’বোন। সাতকানিয়ার রাস্তার মাথা এলাকায় দু’ভাই মিলে একটি মুদির দোকান চালাত।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১১ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯,২০১৩
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।