ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘সংঘাতের কারণ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে নাগরিক সমাজ’

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৪
‘সংঘাতের কারণ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে নাগরিক সমাজ’ ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: ষাটের দশক থেকে দেশের বিভিন্ন গণআন্দোলনে নেতৃত্বের কাতারে আছেন খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী ড.অনুপম সেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

এরপর সামরিক শাসন কিংবা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে কিংবা মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিরবচ্ছিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। স্পষ্টকথন, সত্য উচ্চারণ, নির্মোহ লেখনীর মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার আসনে আসীন ড.অনুপম সেন বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন।


বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন ড.অনুপম সেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, নির্বাচন এবং দেশজুড়ে চলা সংঘাতে নাগরিক সমাজের ভূমিকায় চরমভাবে হতাশ দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী পঁচাত্তরে পা দেয়া এ বুদ্ধিজীবী।

ড.অনুপম সেনের মতে, যারা নিজেদের সিভিল সোসাইটি কিংবা নাগরিক সমাজ বলে পরিচয় দেন বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের যে ভূমিকা নেয়া উচিৎ ছিল তারা সেটি নিতে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা নেননি। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা হয় রাজনৈতিক সংঘাতের গতিপ্রকৃতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা বুঝতে চাচ্ছেন না। তারা বুঝতে চাচ্ছেন না, দেশে যা চলছে তা শুধুমাত্র ক্ষমতার সংঘাত নয়, এটি বিপ্লবীর সঙ্গে প্রতিবিপ্লবীর লড়াই। এটি বিজয়ীদের সঙ্গে পরাজিতদের লড়াই। বাংলাদেশের অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই।

মুক্তিযুদ্ধে নাগরিক সমাজের একাংশের ভূমিকার কথা তুলে ধরে ড.অনুপম সেন বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এর আগেও শিক্ষিত বাঙালী সম্প্রদায়ের মধ্যে, বাঙালী সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল একটি চক্র ছিল। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়ে গেল, তখন তাদের অনেকেই নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে কিংবা বাড়াতে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তারা যে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনা ধারণ করত না, সেটা একাত্তর পরবর্তী সময়ে পরিস্কার হয়ে যায়। তাদের সব চেষ্টাই নিজেদের শ্রেণী, নিজেদের গোষ্ঠীকে বিত্তবান করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্মের পরই প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষিত সম্প্রদায় এবং সামরিক-বেসামরিক আমলাগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিল সেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির শাসনকাল। নাগরিক সমাজ নামের সেই গোষ্ঠীটি এ দেড় দশকের শাসনকালে সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক  ও গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে থেকে তাদের শক্তি যুগিয়েছে। সব সামরিক সরকারের আমলে তথাকথিত একটি নাগরিক সমাজ স্বৈরশাসকের পক্ষে থাকে, তাদের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে আবার সুযোগ বুঝে তাদের ছুঁড়ে ফেলে।

আলাপচারিতায় পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে প্রতিবিপ্লবীদের উত্থানের কারণও ব্যাখা করেন ড.অনুপম সেন, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে নিবিড়ভাবে দেখছেন। বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্যে অনুপম সেন প্রতিবিপ্লবীদের যারা সহযোগিতা দিয়ে পুষ্ট করছেন তাদেরও সমালোচনা করেন।

অনুপম সেন বলেন, প্রতিটি বিপ্লবের সময়ই মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠে। মানুষ ভাবতে শুরু করেন, বিপ্লব শেষ হলে তাদের সব চাওয়া পূর্ণ হবে। কিন্তু বিপ্লবউত্তর কালে বিধ্বস্ত অর্থনীতির কারণে জনগণের বিশাল ও বিপুল প্রত্যাশাকে সবসময় বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব হয়না। এতে জনমনে হতাশা দেখা দেয় এবং সেই সুযোগটাই নেয়ার চেষ্টা করে প্রতিবিপ্লবীরা।

তিনি বলেন, পঁচাত্তর উত্তর সময়ে প্রতিবিপ্লবীরা, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশে এ সুযোগটাই নিয়েছে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে কুক্ষিগত করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছে। আর তাদের উচ্ছিস্টভোগী হিসেবে জন্ম নিয়েছে তথাকথিত একটি নাগরিক সমাজ কিংবা সুশীল সমাজ। এই নাগরিকরা দলনিরপেক্ষতার ভান করে, জনগণের পক্ষে কথা বলার ভান করে। আসলে তারা যা চায় তা হল নিজের ক্ষমতা। সামান্য একটা দূতের পদের জন্য তারা লালায়িত থাকে। সেটা না পেলে তারা পুরো জনগণের বিরুদ্ধে যেতে দ্বিধাবোধ করেনা। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তির পদলেহন করতেও তাদের দ্বিধাবোধ হয়না।

ড.অনুপম সেন বলেন, এটা সত্য যে, একাত্তরে দেশের সব মানুষ  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল পঁচাত্তরের পর তারা ধর্মকে আশ্রয় করে বিভিন্নভাবে পুর্নবাসিত হয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে, বিত্তবৈভব অর্জন করে বিপুলভাবে। দু:খের বিষয় তারা এটি করছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হিসেবে দাবিদার বিএনপির মত একটি বড় দলের ছত্রছায়ায় থেকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, দেশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ এবং বিপক্ষ প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী শক্তিতে বিভক্ত হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিটি দেশের বিভিন্ন মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিদেশি অর্থপুষ্ট এনজিও মালিক যারা নিজেদের নাগরিক সমাজ কিংবা সুশীল সমাজ বলে পরিচয় দেয় তাদেরও নিয়ন্ত্রণ করছে। কারণ, তাদের বক্তব্য অনুসরণ করলে বোঝা যাবে, তারা অত্যন্ত সুকৌশলে প্রতিক্রিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তারা ভাবেন, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ক্ষমতায় গেলে বিভিন্নভাবে তারাও ক্ষমতার ভাগ পাবেন। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধানের মূলনীতি অত্যন্ত গৌণ।

দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংঘাতের বিষয়টি উল্লেখ করে অনুপম সেন বলেন, আওয়ামী লীগ একাত্তরে যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল তাদের বিচার করছে। আওয়ামী লীগ ইতিহাসের দায় মেটাচ্ছে। এতে প্রতিবিপ্লবীরা সহিংস হয়ে উঠেছে।

তিনি বলেন, বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবীরা হয়ত কখনও কখনও জয়ী হয়। প্রতিবিপ্লব মাঝে মাঝে শক্তিশালী হয়। তবে শেষ বিচারে জয়ী হন বিপ্লবীরা। হয়ত সময় লাগবে, কিন্তু প্রতিবিপ্লবীরা জিততে পারবেনা। কারণ প্রতিবিপ্লব সাধারণ মানুষের জন্য নয়। যে মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, যে মেয়ে উপার্জন করতে শিখেছে, প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীরা কি তাকে আবার ঘরে ঢুকিয়ে দিতে পারবে ? এটা কখনও সম্ভব নয়।

প্রতিবিপ্লবীদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দেখেছি। এ আন্দোলনের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র মিল নেই। সেসব আন্দোলনে কারফিউ ভেঙ্গে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসত। সহিংসতা কখনও হতনা। পুলিশ, আর্মি গুলি করলে মানুষ বুক পেতে দিয়েছে। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে সেটা কোন গণআন্দোলন নয়, জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত পরিকল্পিত সহিংসতা।

নাগরিক সমাজ গণতন্ত্রকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে অভিযোগ করে ড. অনুপম সেন বলেন, যেখানে প্রতিবিপ্লবীদের বিচার হচ্ছে, তাদের ফাঁসি হচ্ছে সেখানে তারা নির্বাচনে যাবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে সেটা আশা করাই তো বোকামি। কিন্তু তথাকথিত নাগরিক সমাজ কিংবা সুশীল সমাজ নির্বাচনকে অগণতান্ত্রিক বলছে। নির্বাচন যদি অগণতান্ত্রিক হত তাহলে বিরোধী দলের আন্দোলনে তো মানুষ রাস্তায় নেমে আসত।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৪
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।