ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

তুমি ঘুমাওনি এখনো?

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৪
তুমি ঘুমাওনি এখনো?

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম শহরের খুব সাধারণ এলাকায় ছোট্ট ছিমছাম একটি বাসা। সেই বাসার একটি কক্ষে প্রায় পাঁচ বছর ধরে শয্যাশায়ী চলৎশক্তিহীন, প্রায় বাকশক্তিহীন ষাটোর্ধ এক নারী।

সেই কক্ষ থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসে শুধু গোঙানির আওয়াজ। সেই আওয়াজে সচকিত হন তাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টায় রত হৃদরোগে আক্রান্ত সত্তরোর্ধ স্বামী।


একবুক আশা নিয়ে ছুটে যান স্ত্রীর পাশে, এই বুঝি স্ত্রী শয্যা ছেড়ে উঠে বলবে, কি-রে তুমি ঘুমাওনি এখনো ? এই বুঝি প্রিয়তমা স্ত্রী গলা ছেড়ে গেয়ে উঠবে জীবনের জয়গান।

জীবনের পড়ন্ত বেলায় সহধর্মিণীর জন্য অফুরান ভালবাসার এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.অনুপম সেন। দেশবরেণ্য এ বুদ্ধিজীবীকে সরকার এ বছর একুশে পদকে ভূষিত করার ঘোষণা দিয়েছে।

১৯৯৩ সালে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্ম অনুসন্ধানে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন ড.অনুপম সেন। দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল যে কোন গণআন্দোলনে নেতৃত্বের কাতারে থাকা এই বুদ্ধিজীবী এখনও ক্লান্তিহীনভাবে ছুটে যান যে কোন সভা-সেমিনার কিংবা মিছিলে। এখনও তিনি লিখে চলেছেন নিয়মিত। সদাহাস্য এই মানুষটিকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই কত যন্ত্রণা তিনি আড়াল করেছেন হাসি দিয়ে।

শীতের এক সকালে বাসায় বসে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন ড.অনুপম সেন। আলাপচারিতায় স্ত্রীর প্রসঙ্গ তুলতেই সরাসরি তার কক্ষে নিয়ে যান। ইলেকট্রিক্যাল বেডে শুয়ে থাকা স্ত্রী উমা সেনকে দেখিয়ে বলেন, পাঁচ বছর ধরে এভাবেই শুয়ে আছে সে। আমাকে চিনতে পারেনা। আমি কিছু বললেও বুঝতে পারেনা।

এসময় ক্যামেরার আলো জ্বলে উঠে, গোঙানির মত আওয়াজ দেন উমা সেন। তাড়া দেন অনুপম সেন, ও বিরক্ত হচ্ছে, ক্যামেরা বন্ধ করুন, চলুন আমরা বাইরে যাই।

আলাপচারিতায় অনুপম সেন জানান, সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময়ের দাম্পত্য জীবন তাদের। ১৯৬৬ সালের শেষদিকে তাদের বিয়ে হয়। ২০০২ সালে ঢাকায় তার মেয়ের বাসায় প্রথম দফা স্ট্রোকে উমা সেনের ডান পা ও ডান হাত অবশ হয়ে যায়। এরপর ২০০৯ সালে ব্রেন স্ট্রোকে সেমিকোমায় চলে যান তিনি।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনুপম সেন বলেন, ‘আমি সকালে ইউনিভার্সিটি চলে যাচ্ছিলাম। ও দরজা খুলে দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমাকে বলা এটাই তার শেষ কথা। এরপর থেকে পাঁচ বছর ধরে শুধু একবার তার ডাক শোনার অপেক্ষায় আছি। ’

অসুস্থ স্ত্রীকে সেবা দিতে গিয়ে নিজের জীবন বাঁধা পড়ে গেছে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে।   নিজের শরীরেও বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ। তারপরও অনুপম সেনের পেছন ফেরার সময় নেই। ভোর ৬টা থেকে সোয়া ৬টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠেন তিনি। সেমিকোমায় থাকা স্ত্রীকে তার বেডে গিয়ে একপাশ থেকে আরেক পাশ করে দেন। সাড়ে ৬টার দিকে প্রেসক্রিপশন দেখে ভোরের ওষুধ খাওয়ান তাকে।

সাড়ে ৮টার দিকে আরেকবার ওষুধ খাওয়ান স্ত্রীকে। মাঝে যে সময়টা পান সে সময়টাকে বই পড়ার কাজে লাগান অনুপম সেন। ততক্ষণে চলে আসেন সেবিকা। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান অনুপম সেন। দাপ্তরিক কাজ, ক্লাশের তদারকি, মিটিং শেষ করে দুপুর আড়াইটার মধ্যে আবারও বাসায় ফিরেন।

সময় পেলে দুপুরেও বাসায় বসে কিছুক্ষণ বই পড়েন। স্ত্রীকে দুপুরের পথ্য খাইয়ে ছুটেন সভা, সেমিনারে বক্তব্য রাখতে কিংবা মিছিলের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতে। রাত সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে বাসায় ফেরেন। কিছুক্ষণ স্ত্রীর পরিচর্যা শেষে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ভাত খান তিনি। এরপর বাসার সামনে করিডোরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। রাত ১২টার দিকে স্ত্রীকে শেষ পথ্য দিয়ে আবারও কিছুক্ষণ বই পড়েন। রাত ১টার দিকে ঘুমাতে যান তিনি।

পাঁচ বছর ধরে যাপিত জীবনের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হন সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি। ভারী কন্ঠে বলেন, ‘উমা আমার জীবনসঙ্গী। আমার সুখ দু:খের সাথী। তার জন্য তো আমৃত্যু আমাকে করতে হবে। তার জন্য যতটুকু করার দরকার ছিল ততটুকুও তো আমি করতে পারছিনা। ’

অনুপম সেন বলেন, তার কিডনি, লিভার, হার্ট, শরীরের সব অর্গান ঠিক আছে। শুধু ব্রেইন স্ট্রোকে সমস্যা হয়েছে। সে সম্পূর্ণ সুস্থ হবেই। আমৃত্যু আমি এ আশা বাঁচিয়ে রাখব।

তিনি বলেন, আমি যখন রাতে পড়তে বসি, আমার মনে হয় কেউ এসে আমার পিঠে হাত রাখছে। মনে হয়, আমার স্ত্রী এসে বলছে, কিরে তুমি এখনো ঘুমাওনি ? আমি যখন ভার্সিটিতে যাবার জন্য বের হয়, তখন আমার মনে হয় ও হুট করে ‍উঠে একদিন বলবে, তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে আছি।

বলতে বলতে আবার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠে তার। হাসিমুখে সেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট অবয়ব চাপা দিয়ে তিনি বলেন, ‘উমা ভাল গান করত। তার কণ্ঠ খুব মিষ্টি ছিল। মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম নিয়ে সে বসে যেত। দু’আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত গান করত। উমা অসুস্থ হল, কথাই বলতে পারেনা, গান কোত্থেকে করবে। এখন আর আমার গান শোনাই হয়না। ’

ব্যক্তিজীবনে এক কন্যা সন্তানের জনক ড.অনুপম সেন। মেয়ে ইন্দ্রাণী সেন অধ্যাপক স্বামী নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন।

এ পর্যন্ত অনুপম সেনের ১০টি গবেষণাধর্মী এবং ২টি কবিতার বই বের হয়েছে। তার লেখা বই ভারত, কানাডা, আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছে।

বাংলাদেশ সময়: ২২১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।