চট্টগ্রাম: বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে ঘিরে ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েছে জেলা প্রশাসন। বন্দরনগরীতে মানসম্পন্ন অডিটেরিয়াম নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলক ‘বিজয় স্তম্ভ’ নির্মাণ, জেলা শিল্পকলা একাডেমির অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সরকারি অফিসগুলোর আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে এ পরিকল্পনায়।
সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন এ উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা জানান।
আলাপে এছাড়াও জেলায় মাদক ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ, সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, সরকারি কার্যালয়ে সেবাগ্রহীতার ভোগান্তি ও দালালদের দৌরাত্ম কমানোসহ বিভিন্ন সমস্যা, সফলতা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন তিনি।
১১তম বিসিএস’র মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মেজবাহ উদ্দিন। তার বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন এলাকায়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পূর্বে তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
![](files/ctg_DC_08_banglanews24_170136979.jpg)
জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রামে কোন বড় অডিটোরিয়াম নেই। নগরবাসী যে একটা বড় সমাবেশ করবে সেই সুযোগই নেই। ২০০-২৫০ জনের মধ্যে সমাবেশ সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। এ সমস্যা নিরসনে একটি মানসম্পন্ন অডিটেরিয়াম নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি।
নগরীতে বিজয়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, চট্টগ্রাম থেকেই একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখানে কোন বিজয় স্তম্ভ না থাকা হতাশাজনক।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসেও আমাদের শহীদ মিনারে যেতে হয়। শহীদ মিনার তো ৫২র ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর তাই চট্টগ্রামে একটি বিজয় স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আশা করছি বিজয়ের মাসেই কাজ শুরু করতে পারবো।
আলাপে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি চর্চায় জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনুদান ও উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন জেলা প্রশাসক। এসময় জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে শিগগিরই কেন্দ্রীয়ভাবে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
“চট্টগ্রামে শিল্পকলা একাডেমি আছে ঠিক, কিন্তু অবকাঠামোগত ত্রুটির কারণে অনুষ্ঠান করার পরিবেশ এখন অনেকটা নেই বললেই চলে। আমরা শিল্পকলার অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়েছি। শিল্পকলা একাডেমি শিগগিরই পুরোপুরি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত করা হবে। প্রবাসী এক ব্যক্তি এ ব্যাপারে আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন। ”
পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল জেলা হবে চট্টগ্রাম:
চট্টগ্রামে সরকারি বিভিন্ন অফিসে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তি বন্ধ করতে কার্যালয়গুলোকে ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
![](files/ctg_DC_07_banglanews24_410365964.jpg)
তিনি বলেন, এরইমধ্যে জেলা সদর সার্কেল ভূমি অফিস পুরোপুরি ডিজিটাল করা হয়েছে, যেটি সারা দেশেই প্রথম। জেলা রেকর্ড রুমকেও ডিজিটাল করার জন্য এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখাকে ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
“সদর সার্কেল বাংলাদেশের প্রথম কোন এসি ল্যান্ড অফিস যেখানে সেবাগ্রহীতারা অনলাইনে তাদের সব সেবা পাচ্ছে, ওয়েবসাইটে গিয়ে অভিযোগ করতে পারছে। ”
জেলা রেকর্ড রুম ডিজিটালাইজড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনে কেবল যেসব অনিয়মের অভিযোগ আসে তার বেশীরভাগই রেকর্ড রুম এবং এলএ শাখা কেন্দ্রিক। তাই এ দু’টি শাখাকে ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
“রেকর্ড রুমকে ডিজিটাল করতে ৮০ লাখ টাকার বাজেট পাঠিয়েছি। ভূমি প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন আমি বাজেট দিয়ে দিবো। এর মধ্যে ভূমি সচিব এসে দেখে গেছেন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকেও দুইবার ভিজিট করা হয়েছে। রেকর্ড রুম ডিজিটালাইজেশন এর আওতায় আসলে ঘরে বসে রেকর্ড পাওয়া যাবে। দালাল ধরে, লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করতে হবে না। ”
তবে ভূমি অধিগ্রহণ শাখাকে পূর্ণাঙ্গ আধুনিক করতে সময়ের প্রয়োজন উল্লেখ জেলা প্রশাসক বলেন, এটা আমাদের দ্বারা করা সম্ভব নয়, এটা অনেক বড় কাজ, দ্বিতীয় ধাপে এই শাখা ডিজিটালাইজড করা হবে। রেকর্ড রুমের পরই এর কাজ শুরু হবে।
“এলএ শাখা তো এখন কানুনগো সার্ভেয়ার নির্ভর। তারাই অল ইন অল। সার্ভেয়ার যদি বলে ঠিক তবে ঠিক, আর বেঠিক বললে বেঠিক। ডিজিটাল হলে এ সুযোগ আর থাকবে না। মানুষের সেবা দেওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। রাতারাতি তো পরিবর্তন সম্ভব নয়। ”
এছাড়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিচতলায় সেবাগ্রহীতার জন্য চলতি সপ্তাহেই হেল্প ডেস্ক উদ্বোধন হবে বলে জানান মেজবাহ উদ্দিন।
তিনি বলেন, এক সপ্তাহ’র মধ্যেই হেল্প ডেস্ক’র কাজ শেষ হবে। সেখানে সেবাগ্রহীতারা সব তথ্য পাবেন, তাদের জন্য থাকবে ফ্রি ওয়াইফাই জোন। ”
চ্যালেঞ্জ যখন মাদক:
জেলা প্রশাসক জানান চট্টগ্রামে ভয়াবহ আকারে মাদকের বিস্তার হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিস্তার ঘটেছে ইয়াবার।
“আমি যখন খুলনার ডিসি ছিলাম সেখানে ছিল ফেনসিডিল। ভারত থেকে আসতো। সেখানে ফেনসিডিলের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছিলাম। এখানে দেখলাম ইয়াবা। এটা সাইজে এত ছোট যে খুঁজে বের করাও কষ্টসাধ্য। এসব মাদকে আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তেমনি সামাজিক অপরাধও বেড়ে চলছে। ”
![](files/ctg_DC_02_banglanews24_340042013.jpg)
মাদকের বিস্তার রোধে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সামাজিক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে সোচ্চার এবং ভ্রাম্যমান আদালতের নিয়মিত অভিযানের উদ্যোগের মাধ্যমে মাদকের বিস্তার রোধ করা হচ্ছে।
“গত মাসে কেবল মাদক সেবন ও বিক্রির দায়ে ১০৬ জনকে জেল দেওয়া হয়েছে। সামাজিক প্রচারণার অংশ হিসেবে উপজেলায় উপজেলায় সভা করা হচ্ছে। এরইমধ্যে বোয়ালখালি, চন্দনাইশ, পটিয়া এলাকায় মাদকবিরোধী প্রচারণা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগণ থেকে আমরা প্রচুর সহযোগিতা পাচ্ছি। ”
তিনি বলেন, মূলত লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ হয়ে আসে ইয়াবা। তবে, অন্য মাদকেরও প্রচলন কম না। বোয়ালখালিতে মিটিং করে জেনেছি, সেখানে পাহাড়ী মদের চল বেশী। পাহাড়ে কিছু মানুষ এসব মদ তৈরি করে।
তথ্য পেলেই অ্যাকশনে মোবাইল কোর্ট:
জেলায় খাদ্য ও পানিতে ভেজাল, ওষুধে ভেজালসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ব্যাপক হারে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চলছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন।
তিনি জানান, চট্টগ্রাম নগরীর পানি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দুই তৃতীয়াংশেরই নিবন্ধন নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেখে জেলা প্রশাসনের অভিযান চলছে। এর মধ্যে ছয়টা অবৈধ কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও তিনজনকে জরিমানা এবং তিনজনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
“ট্যাপের পানি বিক্রি করে মিনারেল নামে, লাইসেন্স নেই, কিছু নেই। ওষুধের অবস্থাও ভয়াবহ। লেবেল চেঞ্জ করে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। এ অবস্থায় হাজারী গলিতে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি দোকান বন্ধ করার পর ভেজাল কমে এসেছে। ”
সামনে আরো ব্যাপকভাবে অভিযান শুরু হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
“আমাদের সঙ্গে কারো কোন শত্রুতা নেই। কিন্তু অপরাধ নির্মুলে আমরা শক্ত অবস্থানে। যখনই কোন অপরাধের তথ্য পাচ্ছি, সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইল কোর্ট অ্যাকশনে যাচ্ছে। ”
![](files/ctg_DC_banglanews24_956153603.jpg)
এসময় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে সামাজিক অপরাধ কমে আসছে বলেও জানান তিনি।
“আপনারা দেখেছেন কয়েকদিন আগে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের দায়ে কর্ণেল হাটে একসঙ্গে ৭১ জনকে জেল দেওয়া হয়েছে। এত লোককে একসঙ্গে জেল দেওয়া সহজ নয়। প্রত্যেকের জন্য অর্ডার শিট লিখতে হয়, সাজা পরওয়ানা দিতে হয়। ”
তিনি বলেন, রাত ১১টার দিকে ফোনে খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়েছি। ভোর সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এ অভিযান চলেছে।
“অপরাধীকে পুলিশের হাতে দিলে আইনের মারপ্যাচে আসামী ফের বের হয়ে আসে। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত থেকে কেউ ছাড়া পায় না। আমি তো কাউকে জামিন দিই না, তাৎক্ষণিক বিচার। ছয় মাস জেল হলে ছয় মাসই খাটতে হবে। ”
তোয়াজ করার দিন শেষ:
দুর্যোগ প্রবণ এলাকা হিসেবে চট্টগ্রামের পরিচিতি রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড় ধসে বিভিন্ন সময় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও এ সংকট নিরসনে কার্যকর কোন উদ্যোগ নিতে পারেনি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। প্রতিবছর বর্ষা এলেই কেবল তাদের তোড়জোড় বাড়ে, পরে পাহাড়ে পুনরায় চলতে থাকে বসতি নির্মাণ।
জেলা প্রশাসককে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আগে তো আমরা তোয়াজ করে মানুষকে পাহাড় থেকে নামাতাম, যার কারণে তারা আবার গিয়ে সেখানে বসতি নির্মাণ করতো। তোয়াজ করার দিন এবার শেষ।
![](files/ctg_DC_MM_banglanews24_133070951.jpg)
“দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এবার নতুন আইন হয়েছে। দুর্যোগের সময় কারো কাছে সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হলে তাৎক্ষণিক আইন প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। আইন অমান্যকারীদের জেল দেওয়া যাবে। ফলে, এখন যদি কেউ পাহাড় থেকে না নামে তাকে সেখানেই শাস্তি দেওয়া হবে। তোয়াজ করে নামানো হবে না। ”
এর বাইরে অন্যান্য দুর্যোগের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আশ্রয় কেন্দ্র করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু একদিকে শহরে আশ্রয় কেন্দ্র করার বিধান নেই, অন্যদিকে শহরের বাইরে কেউ আশ্রয়ে যেতে চাই না। কারণ তাদের জীবন জীবিকা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত। আর এত লোককে শহরে জায়গা দেওয়ার ও সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৪