কক্সবাজার ঘুরে এসে: কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া আর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বিশাল সীমান্তপথ সংরক্ষিত রাখার কাজ এখন বাস্তবায়নের পর্যায়ে।
নাফ নদীর বাঁধকে সড়কে রূপান্তর এবং টেকনাফ, ঘুমদুম ও নাইক্ষ্যংছড়িসহ তিনটি সীমান্ত পয়েন্ট ধরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
দুটি গাড়ি অতিক্রম করতে পারবে এমন মাপে সড়ক নির্মাণ করে তার পাশেই দেওয়া হবে কাঁটাতারের বেড়া। এতে মিয়ানমার থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ, মানবপাচার ও ইয়াবার চোরাচালান বন্ধ হবে, এমনটাই প্রত্যাশা সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির।
তবে নাফ নদীপথে সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে এখনো বাংলাদেশ অংশে দৃশ্যমান কোনো কাজ চোখে পড়েনি। অন্যদিকে নাফ নদীর তীর ধরে মায়ানমার এরইমধ্যে তাদের ৫৪ কিলোমিটার সীমান্তপথে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে।
বাংলাদেশে কাঁটাতারের বেড়া এবং নাফ নদীর তীর ধরে বিজিবি কিংবা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি চলাচলের রাস্তা দ্রুত বাস্তবায়ন করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন বিজিবি কর্মকর্তারা।
সীমান্তে ঘুরে জানা যায়, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার কাটাবুনিয়া, কচুবুনিয়া, খুরারমুখ, বাহারছড়া, সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ, উখিয়া উপজেলার সোনাইছড়ি, রেজুয়াখালের মুখ, চেপটখালী, মাদারবুনিয়া, মনখালী, মোহাম্মদ শফির বিল, ইনানী, চরপাড়া, পাইন্যাশিয়া, চোয়াংখালী, রূপবর্তী, কুতুবদিয়া উপজেলার তাজিয়াকাটা, নয়াপাড়া, সোনাদিয়া, দক্ষিণপাড়া, গড়িভাঙ্গা, বটতল, ধলঘাটা, সুতরিয়া, মাতারবাড়ি, সাইরার ডেইল, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, নাজিরার টেক, কস্তুঘাট এলাকাকে মানব ও মাদক পাচারকারীরা তাদের রুট হিসেবে ব্যবহার করে।
নাফ নদীর তীর ধরে সড়ক ও কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ হলে মানবপাচারের রুটগুলো বন্ধ করা যাবে বলে মনে করছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
টেকনাফে কথা হয় বিজিবি’র ৪২ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে.কর্ণেল আবু জার আল জাহিদের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, নদীর তীরে সড়ক ও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিষয়টি এখন আর সিদ্ধান্তের পর্যায়ে নেই। এটি বাস্তবায়নের পর্যায়ে চলে গেছে। দুইটি গাড়ি একসাথে চলতে পারে এমন সড়ক নির্মাণ করা হবে। সড়কের পাশে থাকবে কাঁটাতারের বেড়া।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মো.সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় রিফিউজিরা সহজেই ঢুকে পড়ে। ইয়াবার চালানও সহজেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশের ভেতরে ঢুকছে। কাঁটাতার বসলে অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান বন্ধ হবে।
বাংলাদেশের ৩২ জেলা জুড়ে ভারত ও মায়নমারের সঙ্গে ৪ হাজার ২৪৬ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত। এর মধ্যে মায়ানমারের সঙ্গে আছে ১৯৩ কিলোমিটার নৌ ও স্থলসীমান্ত। যার মধ্যে টেকনাফের নাফ নদীর তীর ধরেই ৬৮ দশমিক ২০ কিলোমিটার।
নাফ নদীপথে সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এরই নদীর তীরবর্তী পুরো এলাকা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে মায়ানমার। নতুন বসানো এই কাঁটাতারের বেড়ার পেছনে নির্দিষ্ট দূরত্বে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকি।
সীমান্ত অরক্ষিত থাকার কারণেই বছর বছর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আর ইয়াবা পাচার হয়, এমনটা স্বীকার করে নেন বিজিবি কর্মকর্তারা। তবে তারা জানান, তৎপরতার কারণে এই পাচার ও অনুপ্রবেশ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।
বিজিবি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১১ সালে বিজিবি টেকনাফ সীমান্তপথ দিয়ে আসা এক লক্ষ ৭৯ হাজার ৮৮২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে। ২০১২ সালে উদ্ধার করেছে ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ১২৩ পিস। ২০১৩ সালে উদ্ধার করা হয়েছে ৯ লক্ষ ৯৮ হাজার ৮৭ পিস। আর ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ২৩ লক্ষ ৪৫ হাজার ৯৬২ পিস ইয়াবা।
২০১২ সালে উখিয়া ও টেকনাফ থানায় ইয়াবা উদ্ধার সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১১৬টি। ২০১৩ সালে ১২৮টি এবং ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত হয়েছে ২৬৫টি মামলা।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণেও সক্রিয় রয়েছেন সীমান্ত রক্ষীরা। ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৩৮ জন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা নারীপুরুষকে আটক করে মায়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। ২০১১ সালে ১ হাজার ৭৮৯ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
২০১২ সালে বিজিবি ৩ হাজার ৯৩৭ জন রোহিঙ্গা নারীপুরুষকে আটক করে সেদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। এর মধ্যে ১১ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মাত্র ১৯দিনে ফেরত পাঠানো হয় ৯৫০ জনকে। মায়ানমারে সেসময় জাতিগত সংঘাত চলছিল। এ কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা সেসময় আশংকাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল।
২০১৩ সালে মায়ানমারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার পরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকে। ২০১৩ সালে ২ হাজার ৬৬৫ জন রোহিঙ্গা নারীপুরুষকে আটক করে পুশব্যাক করে বিজিবি। ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ১২৫ জনকে আটক করে পুশব্যাক করে বিজিবি।
এছাড়া ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত এক হাজার ৭৮৮ জন মায়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করে বিজিবি ও পুলিশ আদালতে সোপর্দ করেছে।
তবে এই সতর্ক চোখের ফাঁক গলিয়েও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। ইয়াবা পাচার হয়ে দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে, সে কথা মেনে নেন সীমান্ত রক্ষীরা।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করা রোহিঙ্গা নাগরিকরা কক্সবাজার শহরে এসে পাসপোর্ট পাবার আবেদন করে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা ২০১৩ সালে এক হাজার ৮৮ জন এবং ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ২৭১ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে চিহ্নিত করে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে তাদের বিপক্ষে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।
সূত্রমতে, মানবপাচার, ইয়াবা ও রোহিঙ্গার অবাধ বিস্তার ঠেকাতে উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতীয় টাস্কফোর্সের একটি বৈঠক গত সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে পররাষ্ট্র এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ তদারকিতে নাফ নদীর তীর ধরে সড়ক ও ১৯৩ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। আর কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করবে সরাসরি বিজিবি।
৪২ ব্যাটেলিয়ন বিজিবি’র অধিনায়ক লে.কর্ণেল আবু জার আল জাহিদ বাংলানিউজকে বলেন, তিনদিক থেকে ধাপে ধাপে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ হবে। প্রথমে টেকনাফ, এরপর ঘুমদুম এবং শেষে নাইক্ষ্যংছড়ির দুছড়িতে কাঁটাতারের বেড়া বসবে।
কক্সবাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহি প্রকৌশলী একেএম শফিকুল হক বাংলানিউজকে বলেন, নাফ নদীর ৪৭ কিলোমিটার বাঁধকে সড়ক বানানোর কাজ আমরা শুরু করেছি। ডিজাইন হয়েছে। খুব শিঘ্রই টেন্ডার আহ্বান করা হবে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সেপ্টেম্বর মাসে কক্সবাজারে টাস্কফোর্সের বৈঠকে নেয়া কাঁটাতারের বেড়া ও সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে নাফ নদীর বাঁধ পরিমাপ করেছে। আমরা সড়ক নির্মাণে তাদের সহযোগিতা করব।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মো.সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, নাফ নদীর তীরে উখিয়ার পালংখালি ইউনিয়নের ২৩ কিলোমিটার এলাকা পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড তীরে সড়ক নির্মাণ করবে এবং বিজিবি কাঁটাতারের বেড়া দেবে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে মানবপাচার, চোরাচালান ও অনুপ্রবেশ প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৩, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৪